পাতা:বিবিধ প্রবন্ধ (ভূদেব মুখোপাধ্যায়) দ্বিতীয় ভাগ.djvu/৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

o বিবিধ প্রবন্ধ । বাস্তবিক আর্য্যাবর্বের অপর সকল ভাগের অপেক্ষ, বাঙ্গালা দেশেই শক্তির পূজা বিশেষ প্রবল। বাঙ্গালার বৈষ্ণবেরা এবং মধবাচারী কৃষ্ণভক্তের কেহই সীতা অথবা কোন কৃষ্ণশক্তিকে রাম বা কৃষ্ণ অপেক্ষ প্রাধান্ত প্রদান করেন ন, কিন্তু বাঙ্গালার নিমায়ং বৈষ্ণবের খ্রীরাধিকাকে কৃষ্ণের উপরেও প্রাধান্ত দিয়া থাকেন । বিশেষতঃ নিমাইৎ বৈষ্ণবদিগের মতে গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু ঐরাধিক স্বয়ং এবং সেই জন্যই একান্ত কৃষ্ণপ্রেমময় শরীর। চৈতন্য চরিতামৃতেরও অভ্যন্তরীণ ভাব ঐরূপ । বেদের উপাস্ত ব্ৰহ্ম ক্লীবলিঙ্গ শব্দ । কিন্তু বৈদিক দেবতা ইন্দ্র, বিষ্ণু, রুদ্রাদি সকলেই পুরুষ। বেদে উপাস্ত স্ত্রীদেবতা নাই বলিলেই হয় । “শোভমান হৈমবতীর” কথা আছে, “শ্রমইব রূপ ধারিণী উষার” কথা আছে, “হিরণ্যবর্ণ হরিণী লক্ষ্মীর” নাম আছে, কিন্তু উইার দেবতা বলিয়া বিশিষ্টরূপে উল্লিখিত নহেন । কিন্তু বঙ্গদেশে, কি আর্য্যদিগের মধ্যে কি প্রত্যন্তবাসী বৌদ্ধদিগের মধ্যে কি সাম্প্রদায়িক বৈষ্ণবদিগের মধ্যে সাক্ষাৎ বা পরস্পর সম্বন্ধে শক্তি সেবারই বিশেষ সমাদর এবং গৌরব। এই কারণে এখানে ধৰ্ম্মশাস্ত্রগুলি শক্তি-সাধন-প্রধান তন্ত্রশাস্ত্রের আকার ধারণ করিয়া আছে এবং এখানে সাংখ্যদর্শনের মত বিপৰ্য্যস্ত হইয়া যাওয়াতে অর্থাৎ সাংখ্যোক্ত চিন্ময় পুরুষ তন্থশাস্ত্রে জড়ময় এবং সাংখ্যোক্ত জড়প্রকৃতি তন্ত্রশাস্ত্রে চিন্ময়ী হওয়াতে, বঙ্গদেশে সাংখ্য-দর্শনের সমাদর নূ্যন হইয়া গিয়াছে। এইরূপে সাংখ্যদর্শনের সমাদর অল্প হওয়াতেই বোধ হয় যে, দ্যায়দর্শন এপ্রদেশে অধিক সমাদৃত হইয়াছে । হায় দর্শনে পরমাণুবাদই প্রবল, পুরুষ প্রকৃতি লইয়া কোন বিচার-নাই। কিন্তু আৰ্য্যজাতীয় লোকের প্রকৃতিসিদ্ধ স্বরূপ যে অদ্বৈতবাদ তাহাও বঙ্গদেশে অক্ষুন্ন রহিয়াছে । তন্ত্রেরও চরম কথা বেদান্ত দর্শনের চরম কথা হইতে অভিন্ন। বঙ্গদেশের বেদ আগম বা তন্ত্রশাস্ত্র । তন্ত্রশাস্ত্রে দীক্ষার ব্যবস্থা আছে এবং সেই দীক্ষা গ্রহণে সকল জাতীয় লোকের সমান অধিকার উক্ত হইয়াছে। তদ্ভিন্ন, তন্ত্রশাস্ত্রে ভৈরবী চক্র প্রভৃতি এরূপ সকল সাধন-সমিতির উল্লেখ আছে যাহাতে বর্ণভেদের বিচার নিষিদ্ধ। এই সকল লক্ষণে বোধ হয় যে, বৌদ্ধপ্রবর্তিত সমীকরণ ব্যাপার কিয়ৎপরিমাণে তত্ত্বশাস্ত্র কর্তৃক আর্য্যপ্রণালীর অন্তনিবিষ্ট হইয়া গিয়াছিল এবং তান্ত্রিক ক্রিয়াকাণ্ডের এবং সাধনপ্রণালীর বৃদ্ধি হওয়াতে বৈদিক যজ্ঞবিধির বিধানসকল বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছিল।