পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্ট্রি-প্রদীপ ১২৩ কাটায়—কত অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়ে দু-জনে সংসার করি—সে বলে—ভেবো না লক্ষ্মীটি, মদনমোহন আবার সব ঠিক ক'রে দেবেন । তার ছোটখাটো সুখদুঃখ, আখড়ার বিগ্রহের ওপর গভীর ভক্তি ও বিশ্বাস, তার সেবা—আমার ভাল লাগে। মনে হয় কত মেয়ে দেখেছি, সবারই খুঁত আছে, মালতীর খুঁত নেই। আবার মেয়েরা যেখানে বেশী রূপসী, সেখানে মনে হয়েছে এত রূপ কি ভাল ? মালতীর স্নিগ্ধ খামল মুকুমার মুখের তুলনায় এদের এত নিখুঁত রূপ কি উগ্র ঠেকে ! মোটের ওপর যেদিক দিয়েই যাই—সেই মালতী । এক-একবার মনকে বোঝাই মালতীর জন্তে অত ব্যস্ত হওয়া দুঃখ বাড়ানো ছাড়া আর কি ? তাকে আর দেখতেই পাব না। তাদের আখড়াতে আর যাওয়া ঘটবে না । স্বপ্নকে অঁাকড়ে থাকি কেন ? কিন্তু মন যদি অত সহজে বুঝতো! মালতী একটা মধুর স্বপ্নের মত, বেদনার মত, কত দিন কানে-শোনা গানের স্বরের মত উদয় হয়। তখন সবই মুনীর হয়ে যায়, সবাইকে ভালবাসতে ইচ্ছে করে, সাধুর বকুনি, পাওঠাকুরের জ্ঞাতি-বিরোধের কাহিনী—অর্থাৎ কি করে ওর জ্যাঠতুতো ভাই ওকে ঠকিয়ে এতদিন বটেশ্বর শিবের পাণ্ডাগিরি থেকে ওকে বঞ্চিত রেখেছিল তার সুদীর্ঘ ইতিহাস—সব ভাল লাগে। কিন্তু কোন কথা বলতে ইচ্ছে করে না তখন, ইচ্ছে হয় শুধু বসে ভাবি, ভাবি— সারা দীর্ঘ দিনমান ওরই কথা ভাবি । বটেশ্বরনাথ পাহাড়ের দিনগুলো মনে আমার অক্ষয় হয়ে থাকবে । রূপে, বেদনায়, স্মৃতিতে, অনুভূতিতে কানায় কানায় ভরা কি সে-সব অপূৰ্ব্ব দিন! অনেক দিন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রেমের অমর মধুমুহূৰ্ত্তগুলির ছায়াপাতে তাদের স্মৃতি আমার কাছে চিরপ্তামল। শরতের দুপুরে নিভৃত বননিবিড় অধিত্যকায় চুপ ক’রে ঝরা পাহাড়ী-কুরচি-ফুলের শয্যায় বসে চারি দিকে রৌদ্রদীপ্ত পাহাড়শ্রেণীর রূপ ও শরতের আকাশের সাদা সাদা মেঘখণ্ডের দিকে চেয়ে চেয়ে মালতীর ভাবনাতে সারাদিন কাটিয়ে দিতাম। তিনটাঙার মাঠে বটগাছের সবুজ মগডালে সাদা সাদা বকের সারি বসে আছে, যেন সাদা সাদা অজস্র ফুল ফুটে আছে—কত কি রং, প্রথমে মাটির ধূসর রং, তার পর কালে সবুজ গাছপালা, তার ওপরের পর্দায় নীলকৃষ্ণ পাহাড়, তার ওপরে মুনীল ও সাদা মেঘন্তপ, সকলের নীচে কুলে কুলে ভরা গৈরিক জলরাশি। কিসে যেন পড়েছিলুম ছেলেবেলায় মনে পড়ে— অলসে বহে তটিনী নীর, বুঝি দূরে—অতি দূরে সাগর, তাই গতি মম্বর, শ্রাস্ত, শাস্ত পদসঞ্চার ধীর ! আগে প্রেম কাকে বলে তা জানতাম না, জীবনে তা কি দিতে পারে, তা ভাবিও নি কোন দিন। এখন মনে হয় প্রেমই জীবনের সবটুকু। স্বর্গ কবির কল্পনা নয়—স্বৰ্গ এই পিয়ালতলায়, স্বৰ্গ তার স্মৃতিতে। নয়তো কি এত রূপ হয় এই শিলাস্তৃত অধিত্যকার, ওই উচ্চ মেঘপদবীর, ওই পুণ্যসলিলা নদীর, ওই বননীল দিগন্তরেখার ! দিনে রাতে মালতী আমার ছাড়ে কখন ? সব সময় সে আমার মনে আছে। এই দুপুর, এখন সে আখাড়ার দাওয়ায় পরিবেশন করছে। এই বিকেল, এখন সে কাপড় সেলাই করছে, নর তো মুগকলাই বাড়ছে। এই সন্ধ্য, এখন সে টান-টান ক'রে তার অভ্যস্ত ধরনে চুলটি বেঁধে, ফুল্লাধরে মুল্ল হেসে বিষ্ণুমন্দিরে প্রদীপ দেখাতে চলেছে। আজ মঙ্গলবার, সারাদিন সে