পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মণি ডাক্তার আষাঢ় মাসের প্রথমে জ্যৈষ্ঠের গরমটা কাটিয়া গিয়াছে তাই রক্ষা, যে কষ্ট পাইয়াছিলাম গতমাসে ! এই বাগানঘেরা হাটতলায় কি একটু বাতাস আছে ? কিছু করিতে পারিলাম না এখানেও। আছি তো আজ দেড় বছর। শুধু এখানে কেন, বয়স তো প্রায় বত্রিশ-তেত্রিশ ছাড়াইতে চলিয়াছে, এখনও পর্য্যন্ত কি করিলাম জীবনে ? কত জায়গায় ঘুরিলাম, কোথাও না হইল পসার, না জমিল গ্র্যাকটিস। বাগ-আঁচড়, কলারোর, শিমূলতলী, সত্রাজিৎপুর, বাগান গাঁ, কত গ্রামের নামই বা করিব। কোথাও মাস কয়েকের বেশী চলে না। এই পলাশপাড়ায় যখন প্রথম আসি, বেশ চলিয়াছিল কয়েক মাস। ভাবিয়াছিলাম ভগবান মুখ তুলিয়া চাহিলেন বুঝি । কিন্তু তার পরেই কি ঘটিল, আজ কয়েক মাস একটি পয়সারও মুখ দেখিতে পাই না। 尊 এখন মনে হয় কুণ্ডু বাবুদের আড়তে যখন চাকুরি করিতাম খামবাজারে, সেই সময়টাই আমার খুব ভাল গিয়াছে। আমাদের গ্রামের একজন লোক চাকুরিটা জুটাইয়া দিয়াছিল ; খাতাপত্র লিখিতাম, হাতের লেখা দেখিয়া বাবুরা খুশী হইয়াছিল। আট নয় মাসের বেশী সেখানে ছিলাম ; তার মধ্যে কলিকাতায় যাহা কিছু দেখিবার আছে, সব দেখিয়াছি। চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম, বায়োস্কোপ, থিয়েটার, পরেশনাথের বাগান, কালীঘাটের কালীমন্দির। কি জায়গাই কলিকাতা ! চাকুরিটা যাইবার পরে পরের দাসত্বের উপর বিতৃষ্ণা হইল। ভাবিলাম, ডাক্তারী ব্যবসায় বেশ চমৎকার স্বাধীন ব্যবসা। কুণ্ডুবাবুদের বাড়ির ডাক্তারবাবুকে ধরিয়া তাহার ডিসপেন্সারিতে বসিয়া মাস দুই কাজ শিখিলাম। কিছু বাংলা ডাক্তারী বই কিনিয়া পড়াশুনাও করিলাম। তারপর হইতেই নিজের দেশ ছাড়িয়া এই সুদূর যশোহর জেলার পল্লীতে পল্লীতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। এ গ্রামে ব্রাহ্মণের বাস নাই, হিন্দুর মধ্যে কয়েক ঘর গোয়ালা ও কলু আছে, বাকী সব মুসলমান। পলাশপুরে কারো কোঠা বাড়ি নাই, সকলে নিতান্ত গরীব, সকলেরই খড়ের ঘর। খুব বেশী লোকের বাসও যে এখানে আছে, তাও নয়। যদি বলেন, এখানে কেন ডাক্তারী করিতে আসিয়াছি, তার একটা কারণ নিকটবৰ্ত্তী অনেকগুলি গ্রামের মধ্যে এখানেই হাট বসে। এমন কিছু বড় হাট নয়, তবুও বুধবারে ও শনিবারে অনেকগুলি গ্রামের লোক জড়ো হয়। হাটতলায় ক’খানা খড়ের আটচালা ও সবাইপুরের গাজুলীদের ছ'আনি তরফের কাছারীঘর আছে। কাছারী-ঘরখানা দেওয়াল-বিহীন খড়ের ঘর। বছরের মধ্যে কিস্তির সময় জমিদারের তহশীলদার আসিয়া মাস দুই থাকিয়া খাজনাপত্র আদায় করিয়া চলিয়া যায়। স্বতরাং ঘরখানা ভাল করিবার দিকে কাহারও দৃষ্টি নাই। ঘরের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ, সারা মেঝেতে ইদুরের গৰ্ত্ত, মটকা দিয়া বর্ষার জল পড়ে, ঝড়-ঝাপটা হইলে ঘরের মধ্যে বসিয়াও জলে ভিজিতে হয়। ছ'আনির বাবুদের এহেন কাছারী-ঘরে নায়েবকে বলিয়া কহিয়া আশ্রয় লইয়া আছি । একাই থাকি। এ দিকের সব গায়ের মত এ গায়েও বনজঙ্গল, বাশবন, প্রাচীন আমের বাগান বড় বেশী। হাটতলার তিনদিক ঘিরিয়া নিবিড় বাশবন ও আমবাগান, একদিকে মুড়ি