পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/১৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কিন্নর দল ›ፃ.. তারপরে ও যেন একেবারে কাল্পায় ভেঙে পড়তে চাইচে । ওর সে কান্না শুনলে বড় কষ্ট হয় । ছেলেমানুষের মত কান্না-চীনে মাটির সাধের পুতুলটা ভেঙে গেলে ছোট মেয়ে যেমন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদে তেমনি...স্বামীহীনা সদ্য বিধবার কান্নার মত নয় কান্নাটা-মনে হয় ছেলেমানুষই তো, খেলার ঘরের পুতুল-ভাঙার কান্নাটাই শিখে রেখেচে, বড় মেয়ের মত ট্র্যাজিক কান্না কঁদিতে শেখে নি এখনও । এর পরে রাণীর সঙ্গে আমার দেখা হয় নি বা তার খোজও রাখি নি । যদি বেঁচে থাকে, তার বয়স এখন ছাব্বিশ-সাতাশ, বাপের বাড়িতে ভাইয়ের স্ত্রীর দাসীবৃত্তি করে দুমুষ্টি অন্নসংস্থান করচে, অকালে বুড়ী হয়ে গিয়েচে, হয়তো বা এতদিন শুচিবাই রোগেও ধরেচে। এ ছাড়া আর তার কি হবে ? কিন্তু ওর সেই ছেলেবেলাকার পুকুরঘাটের সেই কুমারী দিনের ছবিটি আমার চিরকাল মনে রয়ে গেলা-পুকুরের বাধা ঘাটে নামচে.দু'আঙুলে ধরে গামছাখানা খেলার ছলে জলে ফেলে দিচ্ছে লীলাময়ী বালিকা...সেই ছবিটা যেন কিছুতেই ভুলতে পারি নে । বাটি-চচ্চড়ি সংসারটা এমন কিছু বড় নয়। মাত্র দুটো মেয়েমানুষ এবং একজন পুরুষের সমবায়ে গঠিত। ডাক্তার, ডাক্তারের বে এবং তাদের এক বিধবা পিসিম, আবার এই পিসিমা ডাক্তারের চেয়ে বছর দশেকের ছোট । সরকারী হাসপাতালের পুরোনো ডাক্তার। চক্ৰধরপুরে বদলী হয়েছে সম্প্রতি । ছোট সংসার—আরও ছোট একখানা বাড়িতে অবস্থিত—বেশ ভাল ভাবেই চলছিল মুখে, শান্তিতে, হাসিতে ও আনন্দে—উদয়াস্ত সুমহান কাল কেটে যাচ্ছিল মোহন ছন্দে। এ হেন সময়ে ডাক্তার একথান চিঠি পেল এই মৰ্ম্মে, কলকাতা থেকে নাকি তার বাপের ছোট কাকার বড় ছেলের রুগ্ন বধু আসছে তার শরীয়ের ক্ষতিপূরণ করতে এই পাহাড়ের দেশে । অলকার স্বামীই ডাক্তারের চেয়ে অনেক ছোট। প্রস্তাবনাটা পিসিমার কাছে উত্থাপিত হলে তো সে প্রতিবাদ করলে, “বেশ, আমুক ছোট বৌদি। আমি কলকাতায় যাব—এখানে থাকতে পারবে না।" ডাক্তার প্রতিবাদ করলে, “তা’হলে এখানে দিন চলবে কি করে ?” “সে আমি কি জানি ভাইপো ।” পিসিমা ঐ বলেই ডাক্তারকে সম্বোধন করে । “কিন্তু বৌমা আসছেন রোগা মানুষ। তাকে দিয়ে তো আর সংসারের কাজ করানো যাবে না। আর তোমাদের বেী তখন হয়ে পড়বে একা—ছেলেপিলে নিয়ে আর ক'দিক সামলাবে বল ? তা ছাড়া কলকাতায় তো দেখছি মামুষের অভাব তেমন নেই।” সুতরাং পিসিমাকে থেকে যেতে হ’ল । অলকার সঙ্গে তার আজ প্রায় পাচ বছরের বিবাদ । সেই বিবাদের বীজেই সে প্রতিবাদ করেছিল। তবে সে প্রতিবাদ টিকলো না কিছুতেই ডাক্তারের প্রবল যুক্তির কাছে । ওদিকে অলকা এল যথাসময়ে। দীর্ঘদিন ম্যালেরিয়ার ভুগে ভুগে তার দেহের সক্রিয় কলকজাগুলি অচলপ্রায় হয়ে গেছে। শরীরের সে কান্তি বা শোভা নেই। মুখশ্ৰী হয়েছে কালিমালিপ্ত। গায়ের হাড়গুলো এমনভাবে বার হয়ে পড়েছে যে, তাদের এক-একথানা করে গোনা যায় আক্লেশে ।