পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্ট্রি-প্রদীপ సి ছেড়ে দিলে না, তার ভাইকে সঙ্গে পাঠালে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় বাগানে ফিরে এসে দেখি হৈ হৈ কাণ্ড । বাবা বাসার নেই, তিনি সেদিন খুব মদ খেয়েছিলেন ; ফেরেননি, তার ওপরে আমরাও ফিরিনি, মা পচাঙে লোক পাঠিয়েছিলেন, সে লোক ফিরে এসে বলেছে ছেলেমেয়েরা তো সন্ধ্যের আগেই সেখান থেকে রওনা হয়েছে! এদিকে নাকি খুব ঝড় হয়ে গিয়েছে, আমরা আরও উচুতে থাকবার জন্যে ঝড় পাইনি—নীচে নাকি অনেক গাছপালা ভেঙে পড়েছে। এই সব ব্যাপারে মা ব্যস্ত হয়ে সাহেবের বাংলোয় খবর পাঠান—ছোট সাহেব চারিধারে আমাদের খুজতে লোক পাঠিয়েছে। মা এতক্ষণ র্কাদেননি, আমাদের দেখেই আমাদের জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন—সে এক ব্যাপার আর কি ! কিন্তু পরদিন যে ঘটনা ঘটল তা আরও গুরুতর। পরদিন চা-বাগানে বাবার চাকরি গেল। কেন গেল তা জানি না। অনেক দিন থেকেই সাহেবরা নাকি বাবার ওপর,সন্তুষ্ট ছিল না, সেল মাস্টার বাগান দেখতে এসে বাবার নামে কোম্পানীর কাছে কয়েকবার রিপোর্টও করেছিল, বাবা মদ খেয়ে ইদানীং কাজকৰ্ম্ম নাকি ভাল ক'রে করতে পারতেন না, এই সব জন্তে। আমরা যে-রাত্রে পথ হারিয়ে যাই, সে-রাত্রে বাবা মদ খেয়ে বেছ শ হয়ে কুলী লাইনের কোথায় পড়ে ছিলেন—বড় সাহেব সেজন্তে ভারি বিরক্ত হয়। আরো কি ব্যাপার হয়েছিল না হয়েছিল আমরা সে-সব কিছু শুনিনি । বাবা যখন সহজ অবস্থায় থাকতেন, তখন তিনি দেবতুল্য মানুষ। তখন তিনি আমাদের ওপর অত্যন্ত স্নেহশীল, অত ভালোবাসতে মাও বোধ হয় পারতেন না। আমরা যা চাইতাম বাবা দাৰ্জিলিং কি শিলিগুড়ি থেকে আনিরে দিতেন । আমাদের চোখছাড়া করতে চাইতেন না । আমাদের নাওয়ানো-খাওয়ানো গোলমাল বা এতটুকু ব্যতিক্রম হ’লে মাকে বকুনি থেতে হ’ত । কিন্তু মদ খেলেই একেবারে বদলে যেতেন, সামান্ত ছল-ছুতোয় আমাদের মারধর করতেন । হয়তো আমায় বললেন—এক্সারসাইজ করিস নে কেন ? বলেই ঠাস ক’রে এক চড়। তারপর বললেন—উঠবস কর । আমি ভয়ে ভয়ে একবার উঠি আবার বসি—হয়তো ত্রিশ-চল্লিশ বার ক'রে ক’রে পারে খিল ধ’রে গেল—বাবার সেদিকে খেয়াল নেই। মা থাকতে না পেরে এসে আমাদের সাম্লাতেন। সেইজন্তে ইদানীং বাবা সহজ অবস্থায় না থাকলেই আমরা বাসা থেকে পালিয়ে যাই—কে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মার খাবে ? এই সবের দরুন আমরাও বাবাকে ভয় যতটা করি ততটা ভালোবাসিনে । - দু-চারদিন ধরে বাবা-মায়ে পরামর্শ চলল, কি করা যাবে এ অবস্থায় । আমরা বাইয়ে বাইরে বেড়াই কিন্তু সীতা সব খবর রাখে। একদিন সীতাই চুপিচুপি আমার বললে—শোনো দাদা, আমরা আমাদের দেশে ফিরে যাব বাবা বলেছে। বাবার হাতে এখন টাকাকড়ি নেই কিনা— তাই দেশে ফিরে দেশের বাড়িতে থেকে চাকরির চেষ্টা করবে। শীগগির যাব আমরা—বেশ মজা হবে দাদা—না ?...দেশে চিঠি লেখা হয়েছে— আমরা কেউ বাংলা দেশ দেখিনি, আমাদের জন্ম এখানেই। দাদা খুব ছেলেবেলার একবার দেশে গিয়েছিল মা-বাবার সঙ্গে, তখন ওর বয়স বছর তিনেক—সে-কথা ওর মনে নেই। আমরা তো আজন্ম এই পৰ্ব্বত, বনজঙ্গল, শীত, কুয়াশ, বরফ-পড়া দেখে আসছি— কল্পনাই করতে পারিনে এসব ছাড়া আবার দেশ থাকা সম্ভব। তা ছাড়া সমাজের মধ্যে কোনো দিন মানুষ হইনি বলে আমরা কোনো বন্ধনে অভ্যস্ত ছিলাম না, সামাজিক নিয়মকাহনও ছিল আমাদের সম্পূর্ণ অজানা। মানুষ হয়েছি এরই মধ্যে, যেখানে খুনী গিয়েছি, যা খুশী করেছি। কাজেই বাংলা দেশে ফিরে যাওয়ার কথা যখন উঠল, তখন একদিকে যেমন