পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

९१ বিভূতি-রচনাবলী এসব জায়গা আমার চোখে অত্যন্ত কুত্ৰ মনে হয়, মন ভরে ওঠে এমন একটা দৃশু এর কোনো দিকেই নেই—ঝর্ণ নেই, বরফে মোড়া পৰ্ব্বত-পাহাড় নেই—আরো কত কি নেই। সীতারও তাই, একদিন সে চুপিচুপি বললে—এখানে থাকতে তোমার ইচ্ছে হয় দাদা ? আমায় যদি এখুনি কেউ বলে চা-বাগানে চল, আমি বেঁচে যাই । আর একটা কথা শোনো দাদা—জ্যাঠাইম কি খুড়ীমার ঘরে অত যেও না যেন । ওরা আমাদের দেখতে পারে না। ওদের বিছানায় গিয়ে বসেছিলে কেন দুপুরবেলা ? তুমি উঠে গেলে কাকীমা তোমায় বললে, অসভ্য পাহাড়ী ভূত, আচার নেই বিচের নেই, যখন-তখন বিছানা ছোর ! যেও না ওদের ঘরে যখন-তখন, বুঝলে ? ছোট বোনের পরামর্শ বা উপদেশ নিতে আমার অগ্রজগৰ্ব্ব সঙ্কুচিত হয়ে গেল, বললাম— যা যা, তোঁকে শেখাতে হবে না। কাকীমা মন্দ ভেবে কিছুই বলেননি, আমায় ডেকে তার পরে কত বুঝিয়ে দিলেন পাছে আমি রাগ করি। জানিস তা ? বলা বাহুল্য আমায় ডেকে কাকীমার কৈফিয়ত দেওয়ার কথাটা আমার কল্পনাপ্রসুত । আমাদের জীবনের যে অভিজ্ঞতা এই চার মাসের মধ্যেই সঞ্চয় করেছি, তা বোধ হয় সার জীবনেও ভুলবো না । আমরা সত্যই জানতাম যে, সংসারের মধ্যে এত সব খারাপ জিনিস আছে, মানুষ মানুষের প্রতি এত নিষ্ঠুর হতে পারে, যাদের কাছে জেঠিম, কাকীমা, দিদি ব’লে হাসিমুখে ছুটে গিয়েছি, তারা এতটা হৃদয়হীন ব্যবহার সত্যিই করতে পারে! কি ক’রে জানবই বা এ সব ? মুশকিল এই যে এত সাবধানে চললেও পদে পদে আমরা জ্যাঠাইমাদের কাকীমাদের কাছে অপরাধী হয়ে পড়ি । আমরা লোকালয়ে কখনো বসবাস করিনি বলেই হোক বা এদের এখানকার নিয়ম-কানুন জানিনে বলেই হোক, বুঝতে পারিনে যে কোথায় আমাদের অপরাধ ঘটছে বা ঘটতে পারে। রাত্রে যে কাপড়খানা পরে শুয়ে থাকি, সেইখানা পরনে থাকলে সকালে যে আলনা ছুতে নেই, তার দরুন আলনামুদ্ধ কাচা কাপড় সব নোংরা হয়ে যায়, বা বাড়ির আশপাশের খানিকটা সুনির্দিষ্ট অংশ পবিত্র, কিন্তু সীমানা পেরিয়ে গুেলেই হাত-পা না ধুয়ে বা গঙ্গাজল মাথায় না দিয়ে ঘরদোরে ঢুকতে নেই—এসব কথা আমরা জানিনে, শুনিওনি —যুক্তির দিক দিয়েও বুঝতে পারিনে। আমাদের বাড়ির খিড়কিতে থানিকটা বন, একদিন বিকেলে আমি, সীতা ও দাদা সেখানে কুঁড়েঘর বঁাধবার জন্তে নোনাগাছের ডাল কাটছি— কাকীমা দেখতে পেয়ে বললেন, ওখানে গিয়ে জুটেছ সব ? ভাগ্যিস চোখে পড়ল এক্ষুনি তো ওই সব নিয়ে উঠতে এসে দোতলার দালানে ! “মা গো মা, মেলেচ্ছ থিরিস্টানের মত ব্যাভার, আঁস্তাকুড় ঘেঁটে খেলা হচ্ছে দ্যাখো! সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, আঁস্তাকুড়ের অন্ত কোনো লক্ষণ তো নেই । দিব্যি পরিষ্কার জায়গা, ঘাসের জমি আর বনের গাছপালা । আমি অবাক হয়ে বললাম—- কাকীম, এখানে তো কিছু নোংরা নেই? এসে দেখুন বরং কেমন পরিষ্কার— কাকীমার মুখ দিয়ে খানিকক্ষণ কথা বার হল না—তিনি এমন কথা জীবনে কখনো শোনেননি। তারপর বললেন—চোখে কি ঢালা বেরিয়েছে নাকি ? এটো হাড়িকলসী ফেলা রয়েছে দেখছ না সামনে ?...কাচ কাপড় পরে কোন ছেলেমেয়েট। এই বিকেলে পথ থেকে অত দূরে বনজঙ্গলের মধ্যে যায় ? ওটা স্বাস্তাকুড় হ’ল না ? আবার সমানে তক্‌কো । ভারপর খুড়ীমা ছকুম দিলেন আমাদের সবাইকে এক্ষুনি নাইতে হবে। আমরা অবাক হয়ে গেলাম-নাইতে হবে কেন ?