পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Հ8 বিভূতি-রচনাবলী আমি বললাম—এখন যেও না বাবা। চিঠি আমি দিয়ে আসবখন, তুমি বসে চা-টা খাও। বাবা শুনলেন না, চলে গেলেন। বাবার মুখ শুকনে, দেখে বুঝলাম যেজন্তে গিয়েছেন তার কোনো যোগাড় হয়নি, অর্থাৎ চাকরি। চাকরি না হ’লেও আর এদিকে চলে না। হাতের টাকা ক্রমশ ফুরিয়ে এসেছে। আমরা নীচের যে ঘরে থাকি, গোরুবাছুরেরও সেখানে থাকতে কষ্ট হয়। আমরা এসেছি প্রায় মাস-চারেক হ'ল, এই চার মাসেই যা দেখেছি শুনেছি তা বোধ করি সারা জীবনেও ভুলব না। যাদের কাছে জেঠিম, কাকীম, দিদি বলে হাসিমুখে ছুটে যাই, তারা যে কেন আমাদের ওপর এমন বিরূপ, কেন তাদের ব্যবহার এত নিষ্ঠুর, ভেবেই পাইনে এর কোনো কারণ। আমরা তো আলাদা থাকি, আমাদের খরচে আমাদের রান্না হয়, ওঁদের তো কোনোই অসুবিধের মধ্যে আমরা ফেলিনি, তবু কেন বাড়িমুদ্ধ, লোকের আমাদের ওপর এত রাগ ? আমার বাবার আপন ভাই নেই, ওঁরা হলেন খুড়তুত-জাঠতুত ভাই। জ্যাঠামশায়ের অবস্থা খুবই ভালো—পাটের বড় ব্যবসা আছে, দুই ছেলে গদিতে কাজ দেখে, ছোট একটি ছেলে এখানকার স্কুলে পড়ে, আর একটি মেয়ে ছিল, সে আমাদের আসবার আগে বসন্ত হয়ে মারা গিয়েছে । মেজকাকার তিন মেয়ে-ছেলে হয়নি, বড় মেয়ের বিয়ে হয়েচে—আর দুই মেয়ে ছোট। ছোটকাকার বিয়ে হয়েছে বেশী দিন নয়—বোঁও এখানে নেই। ছোটকাক অত্যন্ত রাগী লোক, বাড়িতে সৰ্ব্বদ। ঝগড়াবীটি করেন, গানবাজনার ভক্ত, ওপরের ঘরে সকাল নেই সন্ধ্যে নেই হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন। জ্যাঠাইমার বয়স মায়ের চেয়ে বেশী, কিন্তু বেশ সুন্দরী—একটু বেশী মোটাসোটা। গায়ে ভারী ভারী সোনার গহন । এর বিয়ের আগে নাকি জ্যাঠামশায়ের অবস্থা ছিল খারাপ— তারপর জ্যাঠাইমা এ বাড়িতে বধুরূপে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারে উন্নতিরও স্বত্রপাত। প্রতিবেশীরা থোশমোদ ক'রে বলে—আমার সামনেই আমি কতবার শুনেছি—তোমার মত ভাগ্যিমানী কজন আছে বড়-বোঁ ? এদের কি-ই বা ছিল, তুমি এলে আর সংসার সব দিক থেকে উথলে উঠলো, কপাল বলে একেই বটে। সামনে বলা নয়—এমন মন আজকাল ক'জনের বা আছে ? দেওয়ায়-খোওয়ায়, খাওয়ানোর-মাখানোয়—আমার কাছে বাপু হক্‌ কথা । মেজখুড়ীমা ওর মধ্যে ভালো লোক। কিন্তু তিনি কারুর সপক্ষে কথা বলতে সাহস করেন না, তার ভাল করবার ক্ষমতা নেই, মন্দ করবারও না। মেজকাক তেমন কিছু রোজগার করেন না, কাজেই মেজখুড়ীমার কোনো কথা এ বাড়িতে খাটে না । বছরখানেক কেটে গেল। বাবা কোথাও চাকরি পেলেন না। কত জায়গায় হঁাটাইটি করলেন, শুকনো মুখে কতবার বাড়ি ফিরলেন। হাতে যা পয়সা ছিল ক্রমে ক্রমে ফুরিয়ে এল। সকালে আমরা বাড়ির সামনে বেলতলায় খেলছিলাম। সীতা বাড়ির ভেতর থেকে বার হয়ে এল, আমি বললুম—চা হয়েছে সীতা ? r সীতা মুখ গৰ্ত্তীর করে বললে—চা আর হবে না। মা বলেছে চা-চিনির পয়সা কোথায় যে চা হবে ? কথাটা আমার বিশ্বাস হ’ল না, সীতার চালাকি আমি যেন ধরে ফেলেছি, এইরকম সুরে তার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললুম—যা, তুই বুঝি থেয়ে এলি ! চা-বাগানে আমাদের জন্ম, সকালে উঠে চা খাওয়ার অভ্যাস আমাদের জন্মগত, চা না খেতে পাওয়ার অবস্থা আমরা কল্পনাই করতে পারিনে ।