পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

| 8 || জ্যাঠামশাইদের বাড়ির শালগ্রামশিলার ওপর আমার ভক্তি ছিল না। ওঁদের জাকজমক ও পূজার সময়কার আড়ম্বরের ঘটা দেখে মন আরও বিরূপ হয়ে উঠল। আগেই বলেছি আমার মনে হ’ত ওঁদের এই পূজা-অৰ্চনার ঘটার মূলে রয়েছে বৈষয়িক উন্নতির জন্তে ঠাকুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো ও ভবিষ্যতে যাতে আরও টাকাকড়ি বাড়ে সে উদ্দেন্তে ঠাকুরের কাছে প্রার্থন জানানো। তাকে প্রসন্ন রাখলেই এদের আয় বাড়বে, দেশে খাতির বাড়বে—আমার জ্যাঠাইমাকে সবাই বলবে ভাল, সংসারের লক্ষ্মী, ভাগ্যবতী—র্তার পয়েতে এসব হচ্ছে, সবাইখোশামোদ করবে, মন যুগিয়ে চলবে। পাশাপাশি অমনি আমার মায়ের ছবি মনে আসে। মা কোন গুণে জ্যাঠাইমার চেয়ে কম ? মাকে চা-বাগানে দেখেছি কল্যাণী মূৰ্ত্তিতে—লোকজনকে খাওয়ানো-মাখানে, কুলীদের ছেলেমেয়েদের পুতির মালা কিনে দেওয়া, আদর-যত্ন করা, আমাদের একটু অমুখে রাত জেগে বিছানায় বসে থাকা। কাছাকাছি কোন চা-বাগানের বাঙালীবাবু সোনাদায় নেমে যখন বাগানে যেত আমাদের বাসায় না খেয়ে যাবার উপায় ছিল না। আর সে-ই মা,এখানে এদের সংসারের দাসী, পরনে ছেড়া ময়লা কাপড়, কাজ করতে পারলে মুখ্যাতি নেই, না পারলে বকুনি আছে, গালাগাল আছে—সবাই হেনস্থা করে, কারও কাছে এতটুকু মান নেই, মাথা তুলে বেড়াবার মুখ নেই। কেন, ঠাকুরকে ঘুষ দিতে পারেন না ব’লে ? আমার মনে হ’ত জ্যাঠাইমাদের শালগ্রামশিলা এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আছেন, তিনি ষোড়শোপচারে পূজো পেয়ে জ্যাঠাইমাকে বড় ক’রে দিয়েছেন, অন্ত সকলের উপর জ্যাঠাইমা যে অত্যাচার অবিচার করছেন, তা চেয়েও দেখছেন না ঠাকুর। একদিন সন্ধ্যাবেলা ঠাকুরঘরে আরতি শুরু হয়েছে ; নর, সীত, সেজ কাকার ছেলে পুলিন আর আমি দেখতে গেছি। পুরুতঠাকুর ওদের সবারই হাতে একটা করে রুপোর্বাধানে চামর দিলে—আরতির সময় তার চামর দুলুতে লাগল। আমার ও সীতার হাতে দিলে না। সীতা চাইতে গেল, তাও দিলে না। একটু পরে ধূপধুনোর ধোয়ায় ও সুগন্ধে দালান ভরে গিয়েছে, বুলু ও ফেণী কাসর বাজাচ্ছে, পুরুতষ্ঠাকুরের ছোট ভাই রাম ঘড়ি পিট্‌চে, পুরুতষ্ঠাকুর তন্ময় হয়ে পঞ্চপ্রদীপে ঘিরের বাতি জেলে আরতি করছে—আমি ও সীতা ছিটের দোলাইমোড়া ঠাকুরের আসনের দিকে চেয়ে আছি—এমন সময় আমার মনে হ'ল এ দালানে শুধু আমরা এই ক'জন উপস্থিত নেই, আরো অনেক লোক উপস্থিত আছে, তাদের দেখা যাচ্ছে না, তারা সবাই অদৃশু । আমার গা ঘুরতে লাগল, আর কানের পেছনে মাথার মধ্যে একটা জায়গায় যেন কতকগুলো পিপড়ে বাসা ভেঙে বেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেল। আমি জানি, এ আমার চেনা, জানা, বহুপরিচিত লক্ষণ, অদৃশ্য কিছু দেখবার আগেকার অবস্থা—চ-বাগানে এরকম কতবার হয়েছে। শরীরের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি হয়—সে ঠিক বলে বোঝানো যায় না, জর আসবার আগে যেমন লোক বুঝতে পারে এইবার জর আসবে, এও ঠিক তেমনি। আমি সীতাকে কি বলতে গেলাম, পিছু হটে গিয়ে দালানের থাম ঠেল দিয়ে দাড়ালাম, গা বমি-বমি ক’রে উঠলে লোকে যেমন ক’রে সে ভাবটা কাটাবার চেষ্টা করে, আমিও সেই রকম স্বাভাবিক অবস্থায় থাকবার জন্তে প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলাম—কিছুতেই কিছু হ’ল না, ধীরে ধীরে পূজার দালানের তিনধারের দেওয়াল আমার সামনে থেকে অনেক দুরে.অনেক দূরে সরে যেতে লাগল’ৰ্কাসর ঘড়ির আওয়াজ ক্ষীর্ণ হয়ে এল-কতকগুলো বেগুনি ও রাঙা রঙের আলোর চাকা যেন একটা আর একটার পিছনে তাড়া করছে “সারি সারি বেগুনি ও রাঙা আলোর চাকার খুব