পাতা:বিভূতি রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড).djvu/৩৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পনেরো শরৎ কাঠের পতুলের মত স্তধ হয়ে বসে রইল কতক্ষণ—এখন সে কিকরবে ? গড়শিবপুরের রাজবংশে সে কি অভিশাপ বহন করে এনেছে, তার বংশের নাম বাবার নাম ভুবতে বসেছে আজ তার জন্যে ! মানুষ এত খারাপও হয় । এই পল্লীগ্রামের বনে বনে হেমন্তকালের কত বনকুসুম, লম্বা লতার মাথায় থোবা থোবা মুকুল ধরেছে বন্য মাখম-সিম ফুলের, শিউলির তলায় খই-ছড়ানো শুভ্ৰ পপের সমারোহ, সমুখ জ্যোৎস্না রাতের প্রথম প্রহরে ছাতিমবনের নিবিড়তায় চাঁদের আলোর জাল-বননি । ছাতিম ফুলের স্বাস-এ সবের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রভাসের মত, বটুকের মত ভয়ানক প্রকৃতির লোক, যাদের অসাধ্য কাজ নেই, যাদের ধম্মাধৰ্ম্ম জ্ঞান নেই। এত কস্ট দিয়েও ওদের মনোবাঞ্ছা মিটলো না ? এতদিন পরে আবার এখানেও এসে জুটলো তার জীবনে আগন জালাতে ? আচ্ছা, সে কি করেছে যার জন্যে তার এত শাস্তি ? সে কি জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে কিছু করেছে ? সে কি স্বেচ্ছায় কমলাদের পাপপুরীর মধ্যে ঢুকুেছিল ? হতে পারে সে নিবোধ, কিছু বুঝতে পারে নি, অত খারাপ কাউকে ভাবতে পারে নি বলেই তার মনে কোনো সন্দেহ জাগে নি, যখন সন্দেহ সত্যই জাগলো— তখন ওরা তো তাকে বেরতে দিল না। অথচ সে যদি সব কথা খুলে বলে গ্রামে, কেউ তাকে বিশ্বাস করবে না । প্রভাসের ও গিরীনের বদমাইশির কথা শুনে ওদের কেউ শাস্তি দেবে না ? ভগবান সত্যের দিকে দাঁড়াবেন না ? না হয়—সে কালোপায়রা দীঘির জলে ডুবে মরে বাবার ও বংশের মুখ রক্ষা করবে। তা সে এখনি করতে পারে—এই দণ্ডে । শধ পারে না বাবার মুখের দিকে চেয়ে । আচ্ছা, সে বশরবাড়ি চলে যাবে দু'দিনের জন্যে ? টুঙি-মাজদে গ্রামে খড়শাশুড়ীর আশ্রয়ে এখন থাকবে গিয়ে কিছুদিন ? কার সঙ্গে পরামর্শ করা যায় ? জ্যাঠামশায় বা বাবাকে এসব কথা বলতে বাধে । তার চেয়ে জলে ডুবে মরা সহজ । সকলে মিলে অমন ভাবে তাকে যদি জালাতন করে, বনের মেটে আল, বনো সিম ভাতে-ভাত এক বেলা খেয়েও যদি শাস্তিতে থাকতে না দেয়, তবে মায়ের মুখে শোনা তারই বংশের কোন পরোনো আমলের রাণীর মত—তারই কোন অতি-বন্ধ প্রপিতামহীর মত নিজের মান বাঁচাবার জন্যে কালোপায়রা দীঘির শীতল জলের তলায় আশ্রয় নিয়ে সব জালা জড়তে হবে, যদি তাতে হতভাগারা শাস্তিতে থাকতে দেয় “চোখের জলে শরতের গালের দ-পাশ ভেসে গেল । কতক্ষণ পরে তার যেন হ’শ হ’ল—কত বেলা হয়েছে । রান্না চড়ানো হয় নি—বাবা জ্যাঠামশায় এসে ভাত চাইবেন এখনি । উঠে সে স্নান করে এল—তেল আগেই মেখে বসে ছিল । বটুক আসবার আগেই । রান্না চড়িয়ে দিয়ে আবার সে ভাবতে বসলো। সব সময়েই ভাবছে, বটুক চলে যাবার পর থেকে। কতবার চোখের জল গড়িয়ে পড়েছে, কতবার অচল দিয়ে মাছেছে। কি সে করে এখন ?