পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/১৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১২৬ বিভূতি-রচনাবলী চার পয়সার এক তাড়া পান দেখাইয়া বলিল—বৈঠকখানা বাজার থেকে ছু পয়সায় স্থাখো মা— সর্বজয়া ভাবে—এবার ছেলের সংসারী হইবার দিকে মন গিয়াছে, হিসাব করিয়া সে চলিতে শিখিয়াছে। অপু ইচ্ছা করিয়াই লীলার সঙ্গে সাক্ষাতের কথাটা উঠায় না। ভাবে, মা মনে মনে ছরাশ পোষণ করে, হয়ত এখনি বলিয়া বসিবে—লীলার সঙ্গে তোর বিয়ে হয় না ?--দরকার কি, অমুস্থ মায়ের মনে সে-সব দুরাশার ঢেউ তুলিয়া ? এমন সব কথা কখনও অপু মায়ের সামনে বলে না, যাহা কিনা মা বুঝিবে না। জগৎ সংসারটাকে মায়ের সীমাবদ্ধ জ্ঞানের উপযোগী করিয়াই সে মায়ের সম্মুখে উপস্থিত করে। দিন-তিনেক সে বাড়ি রহিল। রোজ দুপুরে জানালার ধারের বিছানাটিতে সর্বজয়া শুইয়া থাকে, পাশে সে বসিয়া নানা গল্প করে। ক্রমে বেলা যায়, রোদ প্রথমে ওঠে রান্নাঘরের চালায়, পরে বেড়ার ধারের পলতেমাদার গাছটার মাথায়, ক্রমে বঁাশঝাড়ের ডগায় । ছায়া পড়িয়া যায় বৈকালের ঘন ছায়ার অপুর মনে আবার একটা বিপুল নির্জনতা ও সঙ্গহীনতার ভাব আনে—গত গ্রীষ্মের ছুটির দিনের মত । সর্বজয়া হাসিয়া বলে—পাশটা হ’লে এবার তোর বিয়ের ঠিক করেচি এক জায়গায়। মেয়ের দিদিমা এসেছিল এখানে, বেশ লোক— ঘরের কোণে একটা তাকে সংসারের জিনিসপত্র সর্বজয়া রাখিয়া দেয়—একটা হাড়িতে আমসত্ব, একটা পাত্রে আচার। অপু চিরকালের অভ্যাস অনুসারে মাঝে মাঝে ভাড় হাড়ি খুজিয়া-পাতিয়া মাকে লুকাইয়া এটা-ওটা চুরি করিয়া খায় ! এ কয়দিনও থাইয়াছে। সর্বজয়া বিছানায় চোখ বুজিয়া শুইয়া থাকে, টের পায় না—সেদিন দুপুরে অপু জানালাটার কাছে দাড়াইয়া আছে—গায়ে মায়ের গামছাখানা । হঠাৎ সর্বজয়া চোখ চাহিয়া বলিল—আমার গামছাখানা আবার পিষচো কেন –ওখানা তিলে বড়ি দেবো ব'লে রেখে দিইচি–কুণ্ডুদের বাড়ির গামছ। ওখান, ভারি টনকো—আর সরে সরে তাকটার ঘাড়ে যাচ্চ কেন –ছু সনে তাক—তুমি এমন দুষ্ট হয়েচো, বাসি কাপড়ে ছয়েছিলে তাকটা ? কথাটা অপুর বুকে কেমন বিধিল—ম সেরে উঠে তিলে বড়ি দেবে ? তা দিয়েছে। মা আর উঠছে না—হঠাৎ তাছার মনে হইল, এই সেদিনও তো সে তাক হইতে আমসত্ত্ব চুরি করিয়াছে...ম, অসহায় মা বিছানায় জরের ঘোরে পড়িয়া ছিল...একুশ বৎসর ধরিয়া মারের ম্বে শাসন চলিয়াছিল আজ তাহা শিথিল হইয়া পড়িতেছে, দুর্বল হইয়া পড়িতেছে, নিজের অধিকার আর বোধ হয় প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে না কখনও... অপু চতুৰ্থদিন সকালে চলিয়া গেল, কালই পরীক্ষা। চুকিয়া গেলেই আবার আসিবে। শেষরাত্রে ঘুম ভাঙিয়া শোনে, সর্বজয়ী রান্নাঘরে ইতিমধ্যে কখন ঘুম হইতে উঠিয়া চলিয়া গিয়াছে, ছেলের সঙ্গে গরম পরোটা দেওয়া যাইবে।