পাতা:বিভূতি রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড).djvu/৫১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

অভিযাত্রিক 8booል পরদিন সকালে আমরা বিক্রমখোল রওনা হই। আমাদের সঙ্গে রইল গ্রাম্য পাটোয়ারী ও দুজন ফরেস্ট গার্ড—একখানা গোরুর গাড়িতে আমাদের জিনিসপত্র চললে, কিন্তু আমরা পায়ে হেঁটে যাওয়াই পছন্দ করলুম। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলুম বিক্রমখোল এখান থেকে প্রায় তেরো মাইল । বেলপাহাড় থেকে বিক্রমথোল পর্যন্ত এই পথের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমার মনে চিরকালের ছবি এঁকে রেখে দিয়েচে। কতবার অবকাশমুহূর্তে স্বপ্নের মতো মনে হয় সেই নদী-পৰ্বতঅরণ্য-সমাকুল নির্জন বন্যপথটির স্থতি। প্রথম বসন্তে ফুটন্ত পলাশবনের শোভা ও রঙ ধাতুপ ফুলের সমারোহ সারাপথে, মাঝে মাঝে পাহাড়ী নদীর খাত বেয়ে ঝিরঝির করে জল চলেচে পাথরের মুড়ির রাশির ওপর দিয়ে। এক জায়গায় বড় বড় গাছের ছায়া। সামনে একটি পাহাড়ী নদীর কাঠের পুলের ওপর ঘাসের চাপড়া বিছিয়ে দিচ্চে। ঝরনার দুধারে পাহাড়ী করবীর গাছ ফুলের ভারে জলের ওপর দুয়ে আছে। প্রমোদবাবু প্রস্তাব করলেন, এখানে একটু চা সেরে নেওয়া যাক বলে। কিরণ বললে—চা খাওয়ার উপযুক্ত জায়গা বটে। বমুন সবাই। আমাদের সঙ্গে ফ্ল্যাস্কে চা ছিল, আর ছিল মার্মালেড আর পাউরুটি । মার্মালেডের টিনট এই প্রথম খোলা হল। প্রমোদ ও পরিমল রুটি কেটে বেশ করে মার্মালেড মাখিয়ে সকলকে দিলে—কিরণ চা দিল সবাইকে টিনের কাপে । কিছুক্ষণ পরে কিরণ রুটি মুখে দিয়ে বললে—এত তেতো কেন ? এ— আমিও রুটি মুখে দিয়ে সেই কথাই বললুম। ব্যাপার কি ? শেষে দেখা গেল মার্মালেঙটাই তেতো। মার্মালেড নাকি তেতো হয়, পরিমল বললে। কি জানি বাৰু, চিরকাল পড়ে এসেচি মার্মালেড মানে মোরব্বা, সে যে আবার তেতো জিনিস—তা কি করে জানা যাবে ? এ নাকি সেভিলের তেতো কমলালেবুর খোসায় তৈরী মার্মালেড,টিনের গায়ে লেখা আছে। পরিমল এটা কিনে এনেছিল—তার ওপর সবাই খাপ্পা। কেন বাপু কিনতে গেলে সেভিলের তেতো কমলালেবুর মার্মালেড। বাজারে জ্যাম জেলি ছিল না ? হাটতে হাটতে রৌদ্র চড়ে গেল দিব্যি। বেলা প্রায় এগারোটা।--পথের নব নব রূপের মোহে পথ হাটার কষ্টট আর মনে হচ্ছিল না। এ যেন জনহীন অরণ্যভূমির মধ্যে দিয়ে চলেচি—এতটা পথ চলে এলুম, কোথাও একটা চৰা ক্ষেত চোখে পড়লো না। শুধু পাহাড় আর বন, বন আর পাহাড়। এক জায়গায় পাহাড় একেবারে পথের গা ঘেঁষে অনেক দূর চলেচে। পাহাড়ের ছায়া জাগাগোড়া পথটাতে। আমাদের বাদিকে জমি ক্রমশ ঢালু হয়ে একটা নদীর খাতে গিয়ে মিশলো। সমস্ত ঢালুটা বস্ত-করবী স্কুলের বন। পাহাড়ের ওপর বাশবন এদেশে এই প্রথম দেখলুম। বস্তুবাশ আমি চন্দ্রনাথ ও আরাকান-ইয়োমার পাহাড়শ্রেণী ছাড়া ইতিপূর্বে কোথাও দেখিনি। উড়িয়া ও মধ্যপ্রদেশের আয়ত-শূন্ত আবহাওয়ার এই বক্তবাশ সাধারণত জন্মায় না। ধীশ যেখানে আছে, তা মানুষের সত্বরোপিত।