পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/১৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মরণের ডঙ্কা বাজে S89 জাপানী ভাষায়, ওকে দুজন জাপানী সৈন্য ধরে নিয়ে গিয়ে বাইরে একটা কামানের গাড়ীর উপর বসালে । চারিধারে বহু জাপানী সৈন্য গিজগিজ করছে । সকলেই ব্যস্ত, উত্তেজিত । কোথায় যাবার জন্য সকলেই যেন ব্যগ্র উংস্থক । ● বিমল দেখলে তাকে এরা ছেড়ে দিলে না। মুক্তি যে দিয়েছে তা নয় । কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে ? জাপানী ভাষার সে বিন্দুবিসর্গ বোঝে না, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারে না। মিনিট পনেরোর মধ্যে ঘড়, ঘড় করে কামানের গাড়ী টানতে লাগলো একখানা মোটর লরি। ওর দুদিকে সাজোয়া গাড়ী চলেছে সারি দিয়ে। সাংহাই অতি প্রকাণ্ড শহর, এর আর যেন শেষ নেই, ঘণ্টা দুই চলবার পরে শহরের বাড়ী ঘর ক্রমে কমে আসতে লাগলো। র্যাক মাঠ আর ধানের ক্ষেত । চীনদেশের এ অংশের দৃশ্য ঠিক যেন বাংলাদেশ, তবে এখানে কাছাকাছি নীচু পাহাড় শ্রেণী চোখে পড়ে। কিছুদূরে একটা অনুচ্চ পাহাড়ের ওপারে ঘন ধোয়। রাইফেল ছোড়ার শব্দ আসছে। এক জায়গায় মাঠের মধ্যে পাইন বন । সেখানে কামানের গাড়ী দাড়ালে। বিমল দেখলে একটা উচু ঢালু মত জায়গায় লম্বা সারি দিয়ে জাপানী সৈন্যরা উপুড় হয়ে শুয়ে রাইফেল ধরে ছুড়ছে, এক সঙ্গে পঞ্চাশ ষাটট রাইফেলের আওয়াজ হচ্ছে। ওপাশ থেকেও তার জবাব আসছে ; এটা ষে যুদ্ধক্ষেত্র এতক্ষণ পরে বিমল বুঝতে পারলে ! ওদিকে চীনা নাইনথ রুট আমি জাপানীদের বাধা দিচ্ছে—চীনা সৈন্যবাহিনী সাংহাই ছেড়ে হটে গিয়েছে বটে, কিন্তু জাপানীদের আর এগোতে দেবে না। আর একটু পরে বিমল লক্ষ্য করে দেখলে, পাইন বনের একপাশে গাছের তলায় একরাশ মৃতদেহ জাপানী সৈন্তের। স্ট্রেচারে করে বিমলের চোখের সামনে আরও দুজন মরা কি জ্যাস্ত সৈন্যকে নিয়ে এল, বিমল বুঝতে পারলে না। একটু পরে আহতদের আর্তনাদ কানে যেতেই চিকিৎসক বিমল চঞ্চল হয়ে উঠলো। পাশের একজন জাপানী সৈন্যকে বল্লে পিজিন ইংলিশে —আমাকে ওখানে নিয়ে চল, আমি ডাক্তার, ওদের দেখবো । সব মানুষের দুঃখই সমান। দুঃখপীড়িত মানুষের জাত নেই—তার চীনা নয়, জাপানীও নয়। একটু পরে জাপানী অফিসারের সম্মতিক্রমে বিমল হতাহত সৈন্যদের কাছে গেল দেখতে, যদি তার দ্বারা কোন সাহায্য হয়। যদি মড়ার গাদায় জড়ো করা সৈন্যদের মধ্যে দু-একজন সাংঘাতিক আহত লোক বার হয়—কারণ আৰ্ত্তনাদ সেই গাদার মধ্যে থেকেই আসছিল। আসলে যুদ্ধক্ষেত্রে দাড়িয়ে বিমলের কিন্তু মনে হচ্ছিল না যে এটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র। বইয়ে পড়া বা কল্পনায় দেখা যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। একটা শাস্ত পাইন বন, গোটা তিনেক কামানের গাড়ী, রাইফেল হাতে কতকগুলি সৈন্য উপুড় হয়ে আছে—ওপারে পাহাড়ের ওপর কিছু ধোয়া — কেবল সম্মুখের হতাহত জাপানী সৈন্যগুলি পরিচয় দিচ্ছে যে বিমল কোনো শাস্তিপূর্ণ প্রাকৃতিক দৃশ্বের মধ্যে দাড়িয়ে নেই—যেখানে সে রয়েছে সেখানে মাহুষের জীবন মরণের সঙ্গে সম্পর্ক বড় বেশী ।