পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/১৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 বিভূতি-রচনাবলী অসুখ, সংসারের দারিদ্র্য এবং সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখে পাটকলে চাকুরি নেওয়ার জন্যে অনুরোধ। কি করবে সে ? সে নিতান্ত নিরুপায়। মা-বাপের মলিন মুখ সে দেখতে পারবে না। অগত্য তাকে পাটের কলেই চাকরি নিতে হবে । কিন্তু জীবনের স্বপ্ন তাহলে ভেঙে যাবে, তাও সে যে না বোঝে এমন নয় । ফুটবলের নাম-করা সেন্টার ফরওয়ার্ড, জেলার হাইজাম্প চ্যাম্পিয়ন, নামজাদা সাতারু শঙ্কর হবে কিনা শেষে পাটের কলের বাৰু? নিকেলের বইয়ের আকারের কেীটোতে খাবার কি পান নিয়ে বাড়ন পকেটে করে তাকে সকালের ভে বাজতেই ছুটতে হবে কলে—আবার বারোটার সময় এসে দুটো খেয়ে নিয়েই আবার রওনা-ওদিকে সেই ছ’টার ভে বাজলে ছুটি। তার তরুণ তাজ মন এর কথা ভাবতেই পারে না যে ! ভাবতে গেলেই তার সারা দেহ-মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে—রেসের ঘোড়া শেষকালে ছ্যাকৃড়া গাড়ী টানতে যাবে ? --সন্ধ্যার বেশী দেরি নেই । নদীর ধারে নির্জনে বসে বসে শঙ্কর এই সব কথাই ভাবছিল । তার মন উডে যেতে চায় পৃথিবীর দূর, দূর দেশে—শত দুঃসাহসিক কাজের মাঝখানে। লিভিংস্টোন, স্ট্যানলির মত, হ্যারি জনস্টন, মার্কে পোলো, রবিনসন ক্রুসোর মত। এর জুন্যে ছেলেবেলা থেকে সে নিজেকে তৈরী করেছে—যদিও এ কথা ভেবে দেখে নি অন্যদেশের ছেলেদের পক্ষে যা ঘটতে পারে, বাঙালীর ছেলের পক্ষে তা ঘটা এক রকম অসম্ভব । তারা তৈরী হয়েছে কেরানী, স্কুলমাস্টার, ডাক্তার বা উকিল হবার জন্যে। অজ্ঞাত অঞ্চলের অজ্ঞাত পথে পাড়ি দেওয়ার আশা তাদের পক্ষে নিতান্তই দুরাশা। প্রদীপের মৃদু আলোয় সেদিন রাত্রে সে ওয়েস্টমার্কের বড় ভূগোলের বইখানা খুলে পড়তে বসল। এই বইখানার একটা জায়গা তাকে বড় মুগ্ধ করে। সেটা হচ্ছে প্রসিদ্ধ জার্মান ভূপৰ্য্যটক আণ্টন হাউস্টমান লিখিত আফ্রিকার একটা বড় পৰ্ব্বত–মাউনটেন অফ দি মুন (চাদের পাহাড়) আরোহণের অদ্ভুত বিবরণ ! কত বার সে এটা পড়েছে। পড়বার সময় কতবার ভেবেছে হের হাউস্টমানের মত সেও একদিন যাবে মাউনটেন অফ দি মুন্ন জয় করতে। স্বপ্ন ! সত্যিকার চাদের পাহাড়ের মতই দূরের জিনিস হয়ে থাকবে চিরকাল।” চাদের পাহাড় বুঝি পৃথিবীতে নামে ? সে রাত্রে বড় অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলে সে । . চারধারে ঘন বঁাশের জঙ্গল। বুনো হাতীর দল মড়, মড় করে বঁাশ ভাঙছে। সে আর একজন কে তার সঙ্গে, দুজনে একটা প্রকাগু পৰ্ব্বতে উঠছে ; চারিধারের দৃপ্ত ঠিক হাউস্টমানের লেখা মাউনটেন অফ দি মুনের দৃশ্বের মত। সেই ঘন বঁাশবন, সেই পরগাছা ঝোলানো বড় বড় গাছ, নীচে পচাপাতার রাশ, মাঝে মাঝে পাহাড়ের খালি গা-আর দূরে গাছপালার ফাকে জ্যোৎস্নায় ধোয়া সাদা ধবধবে চিরতুষারে ঢাকা পৰ্ব্বত-শিখরটি - এক একবার দেখা যাচ্ছে, এক একবার বনের আড়ালে চাপা পড়ছে। পরিষ্কার আকাশে দু-একটি তারা এখানে ওখানে। একবার সত্যিই সে যেন বুনো হাতীর গর্জন শুনতে পেলে । সমস্ত বনটা কেঁপে উঠল.এত বাস্তব বলে মনে হল সেটা, যেন সেই ডাকেই তার ঘুম ভেঙে গেল !