পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

切* বিভূতি-রচনাবলী এঞ্জিনিয়ার সাহেব এলেন। কুলীদের নাম-ডাকা হল, দেখা গেল একজন কুলী অনুপস্থিত। অনুসন্ধানে জানা গেল সে একটু আগে ঘাসের বনের দিকে কি কাজে গিয়েছিল, তাকে ফিরে আসতে কেউ দেখে নি । খোজাখুজি করতে করতে ঘাসের বনের বাইরে বালির ওপরে ক’টা সিংহের পায়ের দাগ পাওয়া গেল। সাহেব বন্দুক নিয়ে লোকজন সঙ্গে পায়ের দাগ দেখে দেখে অনেক দূর গিরে একটা বড় পাথরের আড়ালে হতভাগ্য কুলীর রক্তাক্ত দেহ বার করলেন। তাকে তাবুতে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হল। কিন্তু সিংহের কোনো চিহ্ন মিলল না। লোকজনের চীংকারে সে শিকার ফেলে পালিয়েছে। সন্ধ্যার পূৰ্ব্বেই কুলীটা মারা গেল। তাবুর চারিপাশের লম্বা ঘাস অনেকদূর পর্য্যন্ত কেটে সাফ করে দেওয়া গেল পরদিনই। দিনকতক সিংহের কথা ছাড়া তাবুতে আর কোনো গল্পই নেই। তার পর মাসখানেক পরে ঘটনাটা পুরানো হয়ে গেল, সে কথা সকলের মনে চাপা পড়ে গেল। কাজকৰ্ম্ম আবার বেশ চলল । সেদিন দিনে খুব গরম। সন্ধ্যার একটু পরেই কিন্তু ঠাণ্ডু। পড়ল। কুলীদের তাবুর সামনে অনেক কাঠকুটো জালিয়ে আগুন করা হয়েছে। সেখানে তাবুর সবাই গোল হয়ে গল্পগুজব করছে। শঙ্করও সেখানে আছে, সে ওদের গল্প শুনছে এবং অগ্নিকুণ্ডের আলোতে ‘কেনিয়া মনিং নিউজ’ পড়ছে। খবরের কাগজখানা পাচদিনের পুরোনো। কিন্তু এ জনহীন প্রাস্তরে তবু এখানেতে বাইরের দুনিয়ার যা কিছু একটু খবর পাওয়া যায়। তিক্রমল আপ্না বলে একজন মাদ্রাজী কেরানীর সঙ্গে শঙ্করের খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিরুমল তরুণ যুবক, বেশ ইংরেজী জানে, মনেও খুব উৎসাহ । সে বাড়ী থেকে পালিয়ে এসেছে য়্যাডভেঞ্চারের নেশায়। শঙ্করের পাশে বসে সে আজ সন্ধ্যা থেকে ক্রমাগত দেশের কথা, তার বাপ-মায়ের কথা, তার ছোট বোনের কথা বলছে। ছোট বোনকে সে বড় ভালবাসে। বাড়ী ছেড়ে এসে তার কথাই তিরুমলের বড় মনে হয়। একবার সে দেশের দিকে যাবে সেপ্টেম্বর মাসের শেষে। মাস-দুই ছুটি মঞ্জুর করবে না সাহেব ? ক্রমে রাত বেশি হল । মাঝে-মাঝে আগুন নিভে যাচ্ছে, আবার কুলীরা তাতে কাঠকুটো ফেলে দিচ্ছে। আরও অনেকে উঠে শুতে গেল। কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাদ ধীরে-ধীরে দূর দিগন্তে দেখা দিল—সমগ্র প্রান্তর জুড়ে আলো-আঁধারে লুকোচুরি আর বুনো গাছের দীর্ঘ-দীর্ঘ ছায়া। শঙ্করের ভারি অদ্ভূত মনে হচ্ছিল বহুদূর বিদেশের এই স্তন্ধ রাত্রির সৌন্দৰ্য্য। কুলীদের ঘরের একটা খুটিতে হেলান দিয়ে একদৃষ্টে সে সমুদ্রের বিশাল জনহীন তৃণভূমির আলোআঁধার-মাখা রূপের দিকে চেয়ে চেয়ে কত কি ভাবছিল। ওই বাওবাব গাছটার ওদিকে অজানা দেশের সীমা কেপটাউন পর্য্যন্ত বিস্তৃত—মধ্যে পড়বে কত পৰ্ব্বত অরণ্য, প্রাগৈতিহাসিক যুগের নগর জিম্বারি—বিশাল ও বিভীষিকাময় কালাহারি মরুভূমি, হীরকের দেশ, সোনার খনির দেশ !