জানকীবাবুর বিরুদ্ধে পুলিস আরও অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করে। গাঙ্গুলিমশায় খুন হওয়ার পাঁচদিনের মধ্যে তিনি জেলার লোন্-আফিস্ ব্যাঙ্কে সাড়ে ন’শো টাকা জমা রেখেচেন, পুলিসের খানা-তল্লাসীতে তার কাগজ বার হয়ে পড়লো।
তারপর বিচারে জানকীবাবুর যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ হয়।
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
একটা বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল জানবার। জানকীবাবুর সঙ্গে আমি জেলের মধ্যে দেখা করলাম। তখন তাঁর প্রতি দণ্ডাদেশ হয়ে গিয়েচে।
আমাকে দেখে জানকীবাবু ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম—কেমন আছেন জানকীবাবু?
—ধন্যবাদ! কোনো কথা জিগ্যেস করতে হবে না আপনাকে।
—একটু বেশী রাগ করেচেন ব’লে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমায় কর্ত্তব্য পালন করতে হয়েচে, তা বুঝতেই পারচেন।
—থাক ওতেই হবে।
—দেখুন জানকীবাবু, মনের অগোচর পাপ নেই। আপনি খুব ভালোভাবেই জানেন, আপনি কতদূর হীন কাজ করেচেন। একজন অসহায়, সরল বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ—যিনি আপনাকে গাঁয়ের জামাই জেনে আপনার প্রতি আত্মীয়ের মত—এমন কি, আপনার শ্বশুরের মত ব্যবহার করতেন, আপনাকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস ক’রে তাঁর টাকাকড়ির হিসেব আপনাকে দিয়ে লেখাতেন— তাঁকে আপনি খুন করেচেন। পরকালে এর জবাবদিহি দিতে হবে যখন, তখন কি করবেন ভাবলেন না একবার?
—মশায়, আপনাকে পাদ্রি-সায়েবের মত লেক্চার দিতে হবে না। আপনি যদি এখনই এখান থেকে না যান—আমি ওয়ার্ডারকে ডেকে আপনাকে তাড়িয়ে দেবো—বিরক্ত করবেন না।
লোকটা সত্যিই অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির। নররক্তে হাত কলুষিত করেচে, অথচ এখনও মনে অনুতাপের অঙ্কুর পর্য্যন্ত জাগে নি ওর।
আমি বল্লাম—আপনি সংসারে একা, ছেলেপুলে নেই, স্ত্রী নেই। তাঁরা স্বর্গে গিয়েচেন, কিন্তু আপনার এই কাজ স্বর্গ থেকে কি তাঁরা দেখবেন না আপনি ভেবেচেন? তাঁদের কাছে মুখ দেখাবেন কি ক’রে?
জানকীবাবু চুপ ক’রে রইলেন এবার। আমি ভাবলুম, ওষুধ ধরেচে। আগের কথাটা আরও সুস্পষ্টভাবে বললাম। জানি না আজও জানকীবাবুর হৃদয়ের নিভৃত কোণে তাঁর পরলোকগত স্ত্রী-পুত্রের জন্য এতটুকু স্নেহপ্রীতি জাগ্রত আছে কিনা! কিন্তু আমার যতদূর সাধ্য তাঁর মনের সে দিকটাতে আঘাত দেবার চেষ্টা করলাম—বহুদিনের মরচেপড়া হৃদয়ের দোর যদি এতটুকু খোলে!