পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২২৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২১২
বিভূতি-রচনাবলী

কেন যে জানকীবাবু সেখানে গেলেন, তিনি তা আজও ভালো জানেন না।

কিংবা হয়তো রক্ত-পিপাসু বর্ব্বর দেবতার শক্তিই তাঁকে সেখালে যাবার প্ররোচনা দিয়েছিল...কে জানে!

জানকীবাবু বল্লেন—ক্যামেরা নিয়ে যদি যেতাম, তাহোলে তো বুঝতাম ফটো নিতে যাচ্ছি—তাই বলছিলাম, কেন যে সেখানে গেলাম, তা নিজেই ভালো জানিনে!

আমি বল্লাম—সে-মূর্ত্তির ফটো নিয়েছিলেন?

—না, কোনোদিনই না। কিন্তু তার চেয়েও খারাপ কাজ করেছিলাম, এখন তা বুঝতে পারচি।

জানকীবাবু যখন সেখানে গেলেন, তখন ঠিক থম্‌থম্ করচে দুপুরবেলা, পাহাড়ী-পাখীদের ডাক থেমে গিয়েচে, বনতল নীরব, বাঁশের ঝাড়ে ঝাড়ে শুক্‌নো বাঁশের খোলা পাতা পড়বার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

দেবমূর্ত্তির একেবারে কাছে যাবার অত্যন্ত লোভ হোলো—কারণ, কুলিরা সঙ্গে থাকায় এতক্ষণ তা তিনি করতে পারেন নি।

গিয়ে দেখলেন, শিশুর শবের চিহ্নও সেখানে নেই। রাত্রে বন্যজন্তুতে খেয়েই ফেলুক, বা, জংলীরাই নিজেরা খাবার জন্যে সরিয়ে নিয়ে যাক্। অনেকক্ষণ তিনি মূর্ত্তিটার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন—কেমন এক ধরণের মোহ, একটা সুতীব্র আকর্ষণ! সত্যিকার নরবলি দেওয়া হয় যে দেবতার কাছে, এমন দেবতা কখনো দেখেন নি বলেই বোধ হয় আকর্ষণটা বেশি প্রবল হোলো, কিংবা অন্য-কিছু তা বলতে পারেন না তিনি।

সেই সময় ওই কাঠের কবচখানা দেবমূর্ত্তির গলায় ঝুলতে দেখে জানকীবাবু কিছু না ভেবে—চারিদিকে কেউ কোথাও নেই দেখে—সেখানা চট ক’রে মূর্ত্তিটার গলা থেকে খুলে নিলেন।...

আমি বিস্মিতসুরে বল্লাম—খুলে নিলেন! কি ভেবে নিলেন হঠাৎ?

—ভাবলাম একটা নিদর্শন নিয়ে যাবো এদেশের জঙ্গলের দেবতার, আমাদের দেশের পাঁচজনের কাছে দেখাবো! নরবলি খায় যে দেবতা, তার সম্বন্ধে যখন বৈঠকখানা জাঁকিয়ে ব’সে গল্প করবো তখন সঙ্গে-সঙ্গে এখানাও বার ক’রে দেখাবো। লোককে আশ্চর্য্য ক’রে দেবো, বোধহয় এইরকমই একটা উদ্দেশ্য তখন থেকে থাকবে। কিন্তু যখন নিলাম গলা থেকে খুলে, তখনই মশায় আমার সর্ব্বশরীর যেন কেঁপে উঠলো! যেন মনে হোলো একটা কি অমঙ্গল ঘনিয়ে আসচে আমার জীবনে। ও-ধরণের দুর্ব্বলতাকে কখনোই আমল দিই নি—সেটা খুলে নিয়ে পকেটজাত ক’রে ফেললাম একেবারে। মিস্‌মিদের অনেকে এ রকম কবচ গলায় ধারণ করে, সেটাও দেখেচি কিন্তু তারপরে। শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাবার সময় বিশেষ ক'রে একবচ তারা পরবেই।

—তারপর?

—তারপর আর কিছুই না। সাতবছর কবচ আছে আমার কাছে। জংলী-জাতের