তালনবমী २२¢ আরও বছর দুই সুখে-দুঃখে কাটিল । জায়গাটা আমার এত ভালো লাগিয়াছিল যে হয়তো সেখানে আরও অনেকদিন থাকিয়া যাইতাম—কিন্তু স্কুল লইয়াই বাঙালীদের সঙ্গে মাদ্রাজীদের বিবাদ বাধিল । মাদ্রাজৗরা স্কুলের জন্তে বেশি টাকাকড়ি দিত, তাহার দাবি করিতে লাগিল কমিটিতে তাহদের লোক বেশি থাকিবে—ইংরাজির মাস্টার একজন মাদ্রাজী রাখিতেই হইবে, ইত্যাদি। আমি ইংরাজি পড়াইতাম-মাঝে হইতে আমার চাকুরী রাখা দায় হইয়া উঠিল । এই সময়ে আমাদের দেশে একটি হাই স্কুল হইয়াছিল, পূর্বে একবার তাহারা আমাকে লইয়া যাইতে চাহিয়াছিল, ম্যালেরিয়ার ভয়ে যাইতে চাহি নাই—এখন বেগতিক বুঝিয়া দেশে চিঠি লিখিলাম। কিন্তু শেষ পর্য্যস্ত এসব কারণে চেরো গ্রামের মাস্টারি আমায় ছাড়িতে হয় নাই । কিসের জন্য ছাড়িয়া দিলাম পরে সে কথা বলিব । এই সময় একদিন চন্দ্র পাগু চেরো গ্রামে কি কার্য্য উপলক্ষে আসিলেন । আমি তাহাকে অনুরোধ করিলাম আমার বাসায় একটু চা খাইতে হইবে। তাহার গরুর গাড়ী সমেত র্তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়া বাসাবাড়ীতে আনিলাম। বৃদ্ধ ইতিপূৰ্ব্বেই কখনও আমার বাসায় আসেন নাই ; বাড়ীতে ঢুকিয়াই চারিদিকে চাহিয়া বিস্ময়ের স্বরে বলিলেন, “এই বাড়ীতে থাকেন আপনি ?” বলিলাম, "আঙ্কে হ্যা, ছোট গ, বাড়ী তো পাওয়া যায় না—আগে স্কুলের একটা ঘরে থাকতাম। বছর খানেক হ’ল স্কুলের সেক্রেটারি রঘুনাথন এটা ঠিক করে দিয়েচেন ।” পুরানো আমলের পাথরের গাথুনির বাড়ী। বেশ বড় বড় তিনটি কামর), একদিকে একটা সরু যাতায়াতের বারান্দা। জবরদস্ত গড়ন, যেন খিলজিদের আমলের দুর্গ কি জেলখানা -হাজার ভূমিকম্পেও এ বাড়ীর একটু চুন বালি খসাইতে পারিবে না। বৃদ্ধ বলিয়া আবার বাড়ীটার চারিদিকে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। ভাবিলাম বাড়ীটার গড়ন তাহার ভালো লাগিয়াছে, বলিলাম, “সেকালের গড়ন, খুব টনকো—আগাগোড়া পাথরের।” চন্দ্র পাও! বলিলেন, “না, সেজন্যে নয়। আমি এই বাড়ীতে প্রায় ত্রিশ বছর আগে যথেষ্ট যাতায়াত করতাম—এই বাড়ীই হ’ল রঙ্কিণী দেবীর সেবাইত বংশের । ওদের বংশে এখন আর কেউ নেই। আপনি যে এবাড়ীতে আছেন তা জানতাম না।•••তা বেশ বেশ । অনেকদিন পরে বাড়ীটাতে ঢুকলাম কিনা, আমার বড় অদ্ভূত লাগচে । তখন বয়েস ছিল ত্রিশ, আর এখন হ’ল প্রায় বাট।” তারপর অন্তান্ত কথা আসিয়া পড়িল। চা পান করিয়া বৃদ্ধ গরুর গাড়ীতে গিয়া উঠিলেন। আরও বছর খানেক কাটিয়াছে। দেশের স্কুলে চাকুরীর আশ্বাস পাইলেও আমি এখনও ঘাই নাই, কারণ এখানকার বাঙালী-মাদ্রাজী সমস্ত একরূপ মিটিয়া আসিয়াছে, আপাতত: আমার চাকুরীট বজায় রহিল বলিয়াই তো মনে হয়। চৈত্র মাসের শেষ । পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূরবর্তী এক গ্রামে আমারই এক ছাত্রের বাড়ীতে অন্নপূর্ণ পূজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে গিয়াছিলাম—মধ্যে রবিবার পড়াতে শনিবার গরুর গাড়ী করিয়া রওনা হই,
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৩৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।