চাদের পাহাড় ১৩ লুকিয়ে অনেক দূর পর্য্যন্ত নিঃশব্দে তার শিকারের অনুসরণ করে। নির্জন স্থানে সুবিধা বুঝে তার ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ে। যদি তাই হয় ? শঙ্কর অশ্বতর নিয়ে আর এগিয়ে যাওয়া উচিত বিবেচনা করলে না। ভাবলে তাবুতে ফিরেই যাই । সবে সে তাবুর দিকে অশ্বতরের মুখট। ফিরিয়েছে, এমন সময় আবার ঝোপের মধ্যে কি একট। নড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক সিংহগর্জন এবং একটা ধূসর বর্ণের বিরাট দেহ সশকে অশ্বতরের ওপর এসে পড়ল। শঙ্কর তখন হাত চারেক এগিয়ে আছে। সে তখনি ফিরে দাড়িয়ে বন্দুক উচিয়ে উপরি উপরি দুবার গুলি করলে। গুলি লেগেছে কি না বোঝা গেল না, কিন্তু তখন অশ্বতর মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে—ধুসর বর্ণের জানোয়ারটা পলাতক ৷ শঙ্কর পরীক্ষা করে দেখলে অশ্বতরের কাধের কাছে অনেকটা মাংস ছিন্নভিন্ন, রক্তে মাটি ভেসে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় সেটা ছটফট করছে। শঙ্কর এক গুলিতে তার যন্ত্রণার অবসান করলে । তার পর সে তাবুতে ফিরে এল। সাহেব বললে, সিংহ নিশ্চয়ই জখম হয়েছে। বন্দুকের গুলি যদি গায়ে লাগে তবে দস্তুরমত জখম তাকে হতেই হবে কিন্তু গুলি লেগেছিল তো ? শঙ্কর বললে–গুলি লাগাল্লাগির কথ। সে বলতে পারে না । বন্দুক ছুড়েছিল, এই মাত্র কথা। লোকজন নিয়ে খোজাখুজি করে দু-তিন দিনেও কোন আহত বা মৃত সিংহের সন্ধান কোথাও পাওয়া গেল না । জুন মাসের প্রথম থেকে বর্ষ নামল। কতকটা সিংহের উপদ্রবের জন্যে, কতকটা বা জলাভূমির সান্নিধ্যের জন্যে অস্বাস্থ্যকর হওয়ায় তাবু ওখান থেকে উঠে গেল। শঙ্করকে আর কনস্ট্রাকৃশন তাবুতে থাকতে হল না। কিন্তুমু থেকে প্রায় ত্রিশ মাইল দূরে একটা ছোট স্টেশনে সে স্টেশন মাস্টারের কাজ পেয়ে জিনিসপত্র নিয়ে সেখানেই চলে গেল । তিন নতুন পদ পেয়ে উৎফুল্ল মনে শঙ্কর যখন স্টেশনটাতে এসে নামল, তখন বেলা তিনটে হবে। স্টেশন ঘরটা খুব ছোট। মাটির প্ল্যাটফৰ্ম্ম, প্ল্যাটফৰ্ম্ম আর স্টেশন ঘরের আশপাশ কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। স্টেশন ঘরের পিছনে তার থাকবার কোয়ার্টার । পায়রার খোপের মত ছোট। যে ট্রেনখানা তাকে বহন করে এনেছিল, সেখানা কিস্থমুর দিকে চলে গেল। শঙ্কর যেন অকূল সমুদ্রে পডল । এত নির্জন স্থান সে জীবনে কখনো কল্পনা করে নি। এই স্টেশনে সে একমাত্র কৰ্ম্মচারী। একটা কুলী পর্য্যন্ত নেই। সে-ই কুলী, সে-ই পয়েন্টসম্যান, সে-ই সব। এরকম ব্যবস্থার কারণ হচ্ছে যে এসব স্টেশন এখনও মোটেই আয়কর নয়। এর অস্তিত্ব এখনও পরীক্ষা-সাপেক্ষ। এদের পেছনে রেল-কোম্পানী বেশী খরচ করতে রাজী নয় । একখানি ট্রেন সকালে, একখানি এই গেল—আর সারা দিন-রাত ট্রেন নেই।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।