তালনবমী ९६१ অল্পবয়সে বামাচরণ তার মামার বাড়ী থেকে স্কুলে পড়তে। ফোর্থক্লাসে ওঠবার সময়ে ফেল করে সে লেখাপড়া দিলে ছেড়ে । বললে, “ছোট ছোট ছেলেরা উঠবে নিচে থেকে আমার ক্লাসে—তাদের সঙ্গে পড়তে লজ্জা করে।” স্বতরাং বামাচরণের লেখাপড়া হ’ল না। মামারা বললে, “লেখাপড়া যদি না করো বাপু, তবে এখানে বসে বসে অন্নধ্বংস করে আর কি করবে, বাড়ী চলে যাও।” বাড়ী এসে যখন সে বসলে, তখন তার বয়েস চোঁদ-পনরো বছর। অজ পাড়াগায়ে বাড়ী, সেখান থেকে চাকরির চেষ্টা করা চলে না। এই সময়ে তার এক ভগ্নীপতি তাদের বাড়ীতে এলেন কিছুদিনের জন্তে বেড়াতে । তিনি পশ্চিমে কোথায় রেলে চাকরি করেন, বামাচরণকে উপদেশ দিয়ে গেলেন— টেলিগ্রাফি শিখতে । তা হ’লে রেলের চাকরি হবার সম্ভাবনা আছে । কলকাতা থেকে তিনি বামাচরণকে একটা ঢেকিকলও আনিয়ে দিয়ে গেলেন, আর টেলিগ্রাম শেখবার একখানা বই। বামাচরণ সৰ্ব্বদা গভীর চালে থাকতো, সমবয়সী ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে মিশলে তার মান যাবে। আর একটা মজা ছিল তার, সে তাদের নানারকম বৈষয়িক উপদেশ দিত । যেমন হয়তো ছেলের দল ওদের বাড়ীর সামনে কয়েতবেলের গাছে উঠে মহা হৈ-চৈ করচে, ও এসে গম্ভীর মুখে বললে, “এই সব, নাম—গাছ থেকে নাম।” বামাচরণ বললে, “কয়েতবেল তো খাচ্ছিল, এদিকে ঘরে যে অনেকের চাল নেই, সে খোজ রাখিল ? শুধু কয়েতবেলে কি আর পেট ভরবে ? যা, হাতে দু’পয়দা রোজগার হয় তার চেষ্টা করগে যা।” বামাচরণের বিজ্ঞ ধরণের কথাবার্তায় বেশ কাজ হ’ল। পাড়াগ জায়গা, সকলেরই অবস্থা অল্পবিস্তর খারাপ, প্রত্যেক ছেলেই জানে যে তার বাপ-মার অবস্থা ভালো নয়। অতএব বামাচরণের কথায় অনেকেরই মনের মধ্যে কোথায় ঘা লাগলে—তারা মাথা নিচু করে ষে যার বাড়ী চলে গেল । 教 এই সময়ে ওর ভগ্নীপতি এসে ওকে ঢেকিকল দিয়ে গেলেন। গ্রামের ছেলেরা প্রশংসমান দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখতে, বামাচরণ দিনরাত গম্ভীর মুখে ওদের বাড়ীর পশ্চিমের ঘরে বলে টেকিকলটাতে টরে-টক অভ্যাস করচে। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই, শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই, দোল নেই, রাস নেই, শনিবার-রবিবার নেই। কি সে অধ্যবসায় । স্রোণাচার্ধ্যের কাছে ধন্থবিদ্যা শিখতে অর্জুনও বোধ হয় এত অধ্যবসায়, এত মনোযোগে দেখান নি—ত তিনি মল্লভূমিতে কাঠের বিবিধ পার্থী বিদ্ধ করে যতই নাম করুন গিয়ে। বছর খানেক টেলিগ্রাফ শেখবার পর বামাচরণ রেলে চাকরির চেষ্টা করলে ; কিন্তু অদৃষ্টের দোষে কোথাও কিছু হ’ল না। গায়ের ছেলেদের সে বলতে, “জানিস, ই-আর-আর-রেলের টি-আই সাহেব আমার দরখাস্তের জবাব দিয়েচে । তার নিজের হাতের সই আছে।”
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৬০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।