অরণ্যে বেশী দিনের কথা নয়, গত ফাল্গুন মাসের কথা। দোলের ছুটিতে গালুডি বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে বলি যে সিংডুম জেলার এই অঞ্চলে আমি অনেকবার গিয়েচি এবং এখানে আমার কয়েকটি বন্ধু বাড়ীও করেচেন, ছুটি-ছাটাতে গিয়ে কিছুদিন যাপন করবার জন্তে । গালুডি ক্ষুদ্র গ্রাম, এ থেকে চার পাঁচ মাইল দূরে দূরে সব দিকেই পাহাড়ের শ্রেণী ও জঙ্গল। দক্ষিণ-পশ্চিমে স্ববর্ণরেখার ওপারে সিদ্ধেশ্বর ও ধনঝরি শৈলমাল, তার ওদিকে তামাপাহাড় নামে একটি অঙ্গুচ্ছ পাহাড় ; এখানে কয়েক বৎসর পূর্বে একটা তামার খনি ছিল, কোম্পানী ফেল হয়ে যাওয়াতে ঘর, বাড়ী, কারখানা, চিমনি, ম্যানেজারের বাংলো সবই পড়ে আছে, মানুষ জন নেই। জায়গাটার নাম রাখা মাইল্স্। এই নামে একটা ছোট রেলস্টেশনও আছে দেড় মাইল দূরে। রাখা মাইনস এবং তার আশেপাশে ঘন জঙ্গল ও পাহাড়, মাঝে সাঁওতালী বন্য গ্রাম। এই সব বনে হস্তী আছে, শঙ্খচূড় সাপ আছে, ভাল্লুক তো আছেই। এই জঙ্গলে যখন-তখন চলাফেরা করা বিপজ্জনক, বন্দুক না নিয়ে কখনও যাওয়া উচিত নয়। এই পরিত্যক্ত নির্জন স্থানে একটা ভগ্নপ্রায় খড়ের বাংলোতে এক মাদ্রাজী কবিরাজ থাকতেন, তার সঙ্গে বেশ আলাপ হয়েছিল। তার মুখে গল্প শুনেচি–কিছুদিন আগে ছুই বুনো হাতীর লড়াই হয়েছিল পুরোনো কারখানার কাছে। ছুদিন ধরে লড়াই হয়, শেষকালে একটা হাতী মারা যায়। বেশী রাত্রে তার বাংলোর বারান্দায় বাঘ ডাকে, সম্পূর্ণ দিনের আলো না ফুটলে তিনি কখনো বাংলোর বারান্দার দিকের দোর খোলেন না। আমি ইতিপূর্বে অনেকবার যখন গালুডি গিয়েচি, তখন রাখা মাইন ও তার আশেপাশের বনে বেড়াতে গিয়েচি একা একা। এক যাওয়ার কারণ প্রথমতঃ তো ওসব বনের মধ্যে স্বাস্থ্যাম্বেষী অজীর্ণ-রোগগ্ৰস্ত শৌখিন কলকাতার বাবুৰ্ব পায়ে হেঁটে যেতে রাজী হ’ন না, দ্বিতীয়তঃ গভীর বনের মধ্যে বেড়ানোর শখও সবার থাকে না—এতে র্তাদের দোষ দেওয় চলে না অবশ্য । অনেকবার বেড়িয়ে বনের মধ্যে কিছু কিছু জায়গা পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। পরিচয় যখন ঘনিষ্ঠ হয় তখন লোকে স্বভাবতই সেখানে একটু অসতর্ক হয়ে পড়ে। আমিও তাই হয়েছিলাম ; ওদেশে বনে বেড়াতে হ’লে সাধারণতঃ সকালের দিকে যাওয়াই নিয়ম, বেলা দু’টে তিনটের পর অর্থাৎ পড়ন্ত বেলার দিকে বনের মধ্যে থেকে বার হয়ে লোকালয়ের দিকে আসাই ভালো । প্রথম প্রথম এ-নিয়ম খুবই মেনে এসেচি। একজন করে সাওতাল গাইড, সঙ্গে না নিয়ে বনে তোম না। একবার সিদ্ধেশ্বরডুংরি বলে প্রায় পনরো শ' ফুট উচু একটা পাহাড়ের চুড়ায় উঠেছিলাম, সেবারও সঙ্গে ছিল একজন সাঁওতাল ছোকরা। পাহাড়ের ওপর অনেক উচুতে নো হাতী চারা কেঁদগাছ ভেঙে দিয়েচে সেই পথপ্রদর্শক সাঁওতাল ছোকরা জামায় দেখায়। চীহড় ফল,—এক রকম বুনো সীমের মত ফল, তার বীজ পুড়িয়ে খেতে
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৬৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।