তালনবমী રdd দিয়ে বা দিকে কুলামাড়ে বলে একটা ক্ষুদ্র বন্তগ্রাম পার হয়ে পায়ে-চলা স্বড়িপথ ধরে ধনারি পাহাড়ের নিচেকার ঘন বনের মধ্যে ঢুকলাম। পথ ধে আমার একেবারে অপরিচিত তা নয়, আর বেশীদূর অগ্রসর না হ’লেও কুলামাড়ে গ্রামে সাঁওতালী উৎসবে সাঁওতালী নৃত্য দেখতে এর আগেও একবার এসেচি। সুতরাং আমার মনে দ্বিধা বা ভয় থাকবার কথা নয়, ছিলও না । কুলামাড়ে পেছনে ফেলে চলেচি, আমার ডাইনে ধনারি পাহাড় সরু বন্য পথের সমান্তরাল ভাবে যেন বরাবর চলেচে উত্তর-দক্ষিণ কোণ থেকে দক্ষিণ-পূৰ্ব্ব কোণের দিকে। বন ক্রমশঃ গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে তা বেশ লক্ষ্য করুচি । কিছুদূর গিয়ে বা দিক থেকে ও আর একটা শৈলশ্রেণী যেন ক্রমশঃ ধনঝরির গায়ে মেশবার চেষ্টা করচে। যে অরণ্যাবৃত উপত্যক দিয়ে আমি চলেচি সেটা যেন ক্রমশঃ সঙ্কীর্ণ হয়ে আসচে। আমার জানা ছিল এই পথটা বনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে এক জায়গায় ধনঝরি পাহাড় পার হয়ে ওপারে চলে গিয়ে আবার মুসাবনী রোডের সঙ্গে মিশেচে । স্বতরাং মনে কোন উদ্বেগ ছিল না। জানি, ধেতে যেতে আপনা-আপনি মূসাবনী রোডে পড়বোই। নিশিঝর্ণা কোথায় আমার জানা ছিল না ; আমি বনের মধ্যে যেতে যেতে কান খাড়া করে আছি কোথায় ঝর্ণর শব্দ পাওয়া যায়। এক জায়গায় সত্যিই শব্দ পাওয়া গেল জলের, স্কড়িপথটা ছেড়ে নিবিড়তর বনের মধ্যে ঢুকে দেখি একটি ক্ষুদ্র পাৰ্ব্বত্য নদী উপলরাশির উপর দিয়ে বয়ে চলেচে । তার দু’ধারে এক প্রকাও বন্য গাছ—অজস্র বেগুনী রঙের ফুল ফুটে আছে। স্থানটি যেমন সুন্দর তেমনি স্নিগ্ধ, কতক্ষণ বসে রইলাম একটা শিলাখণ্ডে, উঠতে যেন ইচ্ছে করে না । কিন্তু এই বনে থাকা তখন যে উচিত ছিল না, তা তখন বুঝি নি। প্রথমতঃ তো বনের ও সব নিভৃত স্থানে—বিশেষ করে যেখানে জল থাকে, সেখানে বাঘ থাকা বিচিত্র নয়, দ্বিতীয়তঃ বেলা গেল, পথ তখনও কত বাকি সে সম্বন্ধে আমার কোনও ধারণা ছিল না— অথবা ধারণা থাকলেও ভুল ধারণা ছিল। যখন আবার স্বাড়িপথটায় উঠলাম তখন বেলা বেশ পড়ে এসেচে । 鬱 বনের এই অংশের শোভা অবর্ণনীয়। প্রথম বসন্তে কত কি বনের ফুল গাছের মাথা আলো করে রেখেচে, ধনঝরির নীল সামুদেশ এক দিকে খাড়া হয়ে উঠেচে ডাইনে, শালমঞ্জরীর সুবাসে উপত্যকার বাতাস নিবিড় হয়ে উঠেচে, বেলা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সে গন্ধটি যেন আরও বাড়চে ; কতক্ষণ অন্তমনে চলেছি, স্কড়িপথটাও কথন হারিয়ে গেছে খেয়াল ছিল না। হঠাৎ দেখি আমার সামনেই ধনঝরি পাহাড়ের খুব উচু একটি অংশ, সেখানে পাহাড় টপকে ওপারে যাওয়ার কোন উপায় নেই—পথও নেই। স্থানটি সম্পূর্ণ জনমানবহীন। সেই কুলামাড়ে গ্রাম ছাড়িয়ে এসে আর লোকালয় চোখে পড়ে নি। বেলাও পড়েচে, একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তা ছাড়া মুড়িপথটাই বা গেল কোথায় ? বনের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে পথ খুজতে গিয়ে আরও গভীর বনের মধ্যে ঢুকে গেলাম । এ দিকে স্বৰ্ষ্য হেলে পড়েচে। এ বনের মধ্যে আর বেশিক্ষণ দেরি করা উচিত হবে না।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৬৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।