তালনবমী- २¢१ পড়েচে। কারণ তখন প্রদোষের ঈষৎ অন্ধকার কেটে জ্যোৎস্ব ফুটে উঠেচে । এক জায়গায় ওপর দিকে মনে হল যেন গাছে আগুন লেগে ধোয়া বেরুচ্ছে। কৌতুহল হ’ল অত্যস্ত, আপনি আপনি গাছে কি করে আগুন লাগবে ? ওপরে উঠে গিয়ে দেখি সত্যিই এক জায়গায় একটা মোটা শেকডের গা দিয়ে ধোয় বার হচ্ছে—তবে কি ভাবে শেকড়ে আগুন লাগলো তা আজও বলতে পারি না। তখন আমি অনেকখানি ওপরে উঠে গিয়েচি, নিম্নের উপত্যকার গাছপালার মাথা কোকড়া-চুল কাফ্রিদের মাথার মতো দেখাচ্ছে ; চাদের আলো বনের নিবিড় অন্ধকার উপত্যকার মধ্যে এতটুকু চোকে নি, ওপর থেকে ঘন কালো দেখাচ্ছে। আর আমি যেখানে দাড়িয়ে আছি সেখানে চারিদিকে ধনারির বিভিন্ন চূড়ার বনরাজির মাথায় মাথায় শুভ্র ঢেউ। সে জনমানবহীন শৈলমালার উদ্ধ সামুতে জ্যোৎস্না-প্লাবিত শুক্ল চতুর্দশী রাত্রির শোভা ষে দেখে নি তাকে বলে বোঝানো যাবে না সে কি অপূৰ্ব্ব ব্যাপার! এক যেন আমি পৃথিবীর উৰ্দ্ধে কোন দেবলোকে বিচরণশীল আত্মা ; আমার চোখের সম্মুখে ষে দৃশ্য দূর থেকে স্বরে প্রসারিত, কোনো পার্থিব চক্ষু কোনোদিন তা দর্শন করেনি। কিন্তু সেখান থেকে আমার মনে হ’ল আমি সম্পূর্ণ ভুল করেচি, ষে দিক দিয়ে পাহাড়ে উঠেচি সেখান দিয়ে পাহাড় টপকাবার উপায় নেই—ষতই উঠি ততই দেখি আমার চোখের সামনে অর্জুন ও শিববৃক্ষের সাদা সাদা সোজা গুড়িগুলো থাকে থাকে উঠে যেন স্বর্গে উঠেচে। অর্থাৎ পাহাড়ের শিখর দেশের তখনও পৰ্য্যন্ত কোনো পাত্তাই নেই। তাছাড়া ক্লাস্তও খুব হয়ে পড়েচি। বুকের মধ্যে টিপচিপ করে যেন ঢেকির পাড় পড়চে অতিরিক্তি শ্রমের ফলে। এই বন ভেঙে অতখানি উঠে ওপারের ঢালু দিয়ে নামতে পারবো বলে মনে হ’ল ন!—তার চেয়ে যে পথে উঠেচি হাত-পা ভেঙে মরার চেয়ে নিম্ন উপত্যকায় নেমে জ্যোৎস্নার আলোয় আবার না হয় পথ খুজি। বিপদ এলো এতক্ষণে এই নামবার সময়, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে ; একেবারে মৃত্যুর সম্মুখীন হ’তে হ’ল প্রায়। দুর্ঘটনা যখন আসে তখন এমনি অতর্কিতে আসে। যতটা উঠেছিলাম জ্যোৎস্নার আলোতে একরকম করে নৈমে এসে সেই “রাগ’ খানার কাছে পোঁছলাম। "রাগ পার হয়ে নেমে গেলে উপত্যকা আর বেশী নিচে নয়। "রাগ বেয়েই নামতে হবে, কারণ অন্য দিকে নামবার কোন উপায় নেই। অথচ রাগ’ এমন মন্থণ যে হাত পায়ে আঁকড়াবার কিছু নেই—এ ধরণের পাথর বেয়ে ওঠা বরং সহজ, কিন্তু নামা অত্যন্ত কঠিন। তাড়াতাড়িতে আর একটা ভুল করলাম, উপুড় হয়ে না নেমে চিৎ হয়ে নামতে গেলাম। যাই হোক, খানিকটা তো লামলাম দিব্যি, তারপর পাথরখানার উপর দিকের ষে প্রাস্ত হাত দিয়ে ধরেচি সেটা ছেড়ে দিয়ে গড়িয়ে সড়, সড় করে খানিকট নামলাম । তারপর পাথরের গায়ে এক জায়গায় একরাশ শুকনো পাতা জমে আছে, সেখানটিতে পাথরের কোন কাজ আছে ভেবে যেমন পা নামিয়ে দিয়েচি অমনি শুকনো পাতার রাশ হুড় হড় করে সরে গেল—সেই বোকে আমিও খানিকটা গড়িয়ে পড়লাম। অথচ পায়ে আটকাবার কোন খাজ বা উচু-নিচু জায়গা কিছুই পেলাম না।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৭০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।