૨૭૨ বিভূতি-রচনাবলী ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে ঠিক ও লোকটা ওর ওই লম্বা হাতে গল টিপে ধরবে কিংবা ছুরি বুকে বসাবে—সেই ফন্দিতে এতদূর ভুলিয়ে এনেচে । লোকটা নিশ্চয়ই জানতে ধে তার কাছে টাকা আছে, অমুসন্ধান রেখেছিল। কে জানে খোদাদাদ খায়ের দলের লোক কিনা ? গঙ্গাধরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেথা দিলে। একবার সে ভাবলে, দৌড়ে পালাবে ? কিন্তু সে বুড়ো মানুষ, এই জোয়ান পাঞ্জাবী মুসলমানের সঙ্গে দৌড়ের পাল্লায় তার পক্ষে পেরে ওঠা অসম্ভব। কলের পুতুলের মতো গঙ্গাধর গুদামঘরের মধ্যে ঢুকল। আশ্চর্য! গুদামের ওদিকের দেওয়ালটা যে একেবারে ভাঙা ! গুদামের সর্বত্র দেখা যাচ্ছে সেই অস্পষ্ট অন্ধকারে । এক জায়গায় দুটো খালি পিপে ছাড়া কোথাও কিছু নেই। মাকড়সার জাল সববর্ত, অন্ধকারে দেখা যায় না বটে, কিন্তু নাকে মুখে লাগে। একটা কি রকম ভ্যাপসা গন্ধ গুদামের মধ্যে, মেজেট সঁ্যাতসেতে, কতকাল এর মধ্যে যেন মাচুব ঢোকে নি । এদিকে আবার খাসাহেব কোথায় গেল ? লোকটা থাকে থাকে যায় কোথায় ? অল্পক্ষণ মিনিট দুই হবে, কেউ কোথাও নেই, শুধু গঙ্গাধর একলা...আবার সেই ভয়টা হ’ল। কেমন এক ধরনের ভয়--ধেন বুকের রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে। এই বা কি রকম ভয় ? আর গুদামঘরটার মধ্যে কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ার যেন একটা স্রোত বইচে মাঝে মাঝে । মিনিট-দুই পরেই খাসাহেব—এই তো আধ-অন্ধকারের মধ্যে সামনেই দাড়িয়ে ।••• হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা বললে খাসাহেব। বললে, “তুমি কালা নাকি ? এতক্ষণ কথা । বলচি, শুনতে পাচ্ছ না ? কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন ? কোকেন যে জায়গায় আছে বললাম, তা দেখতে পেয়েচ। শাবলের চাড় দিয়ে তুলতে বললাম পিপে দুটো। ই করে সঙের মতো দাড়িয়ে কেন ?” বা রে । এত কথা কখন বলেচে লোকটা ? পাগল নাকি ? গঙ্গাধর কেমন ভ্যাবাচাকা হয়ে গিয়েছে, মূঢ়ের মতো দৃষ্টিতে চেয়ে বললে, “কখন তুমি দেখালে কোকেনের জায়গা–কই কোথায় শাবল ?” ••• 象 কথা বলতে বলতে গঙ্গাধর সম্মুখস্থ থাসাহেবের মুখের দিকে চাইলে। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হ’ল তার বিভ্রান্ত, বিমূঢ়, আতঙ্কাকুল দৃষ্টির সামনে খাসাহেবের মুখ, গল, বুক, হাত-প, সারা দেহটা যেন চুরচুর হয়ে গুড়িয়ে গুড়িয়ে পড়চে-সব যেন ভেঙে বাতালে উড়ে উড়ে যাচ্ছে” খাসাহেব প্রাণপণে দাতমুখ খামুটি করে বিষম মনের জোরে তার দেহের চুর্ণায়মান অণুগুলো যথাস্থানে ধরে রাখবার জন্যে চেষ্টা করচে । কিন্তু পেরে উঠচে না---সব ভেঙে গেল, গুড়িয়ে গেল, উড়ে গেল•••এক •••দুই•••তিন•••চার••• আর কোথায় খাসাহেব ? চারিপাশের অন্ধকারের মধ্যে সে মিশিয়ে গিয়েচে•••একটা ঠাও। কনকনে বাতাসের ঝাপটা এলো কোথা থেকে, সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গাধর আর্তরবে চীৎকার করে গুদামঘরের স্যাতসেতে মেঝের ওপর মূচ্ছিত হয়ে পড়ে গেল।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৭৫
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।