চাদের পাহাড় 36. করে দাড়িয়ে রইল। খুব বেশীক্ষণ ছিল না হয়তে মিনিট দুই-কিন্তু শঙ্করের মনে হল সে আর সিংহটা কতকাল ধরে পরস্পরে পরস্পরের দিকে চেয়ে দাড়িয়ে আছে। তার পর সিংহ ধীরে ধীরে অনাসক্ত ভাবে দরজা থেকে সরে গেল। শঙ্কর হঠাৎ যেন চেতনা ফিরে পেল। সে তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজার আগলটা তুলে দিলে। এতক্ষণে সে বুঝতে পারলে স্টেশনের চারিদিকে কাটা তারের বেড়া কেন আছে! কিন্তু শঙ্কর একটু ভুল করেছিল—সে আংশিক ভাবে বুঝেছিল মাত্র, বাকী উত্তরটা পেতে দু-একদিন বিলম্ব ছিল। সেট এল.অন্য দিক থেকে। পরদিন সকালের ট্রেনের গার্ডকে সে রাত্রের ঘটনাটা বললে। গার্ড লোকটি ভাল, সব শুনে বললে—এসব অঞ্চলে সৰ্ব্বত্রই এমন অবস্থা। এখান থেকে বারো মাইল দূরে আর একটা তোমার মত ছোট স্টেশন আছে—সেখানেও এই দশা । এখানে তো যে কাণ্ড— সে কি একটা কথা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ কথা বন্ধ করে ট্রেনে উঠে পড়ল। যাবার সময় চলন্ত ট্রেন থেকে বলে গেল, বেশ সাবধানে থেকে সৰ্ব্বদা— শঙ্কর চিন্তিত হয়ে পড়ল—এরা কি কথাটা চাপা দিতে চায় ? সিংহ ছাড়া আরও কিছু আছে নাকি ? যাহোক, সেদিন থেকে শঙ্কর প্ল্যাটফৰ্ম্মে স্টেশনে ঘরের সামনে রোজ আগুন জালিয়ে রাখে। সন্ধ্যার আগেই দরজা বন্ধ করে স্টেশন ঘরে ঢোকে—অনেক রাত পৰ্য্যস্ত বসে পড়াশুনো করে বা ডায়ের লেখে। রাত্রের অভিজ্ঞতা অদ্ভূত। বিস্তৃত প্রাস্তরে ঘন অন্ধকার নামে, প্ল্যাটফর্মের ইউকা গাছটার ডালপালার মধ্যে দিয়ে রাত্রির বাতাস বেধে কেমন একটা শব্দ হয়, মাঠের মধ্যে প্রহরে প্রহরে শেয়াল ডাকে, এক একদিন গভীর রাতে দূরে কোথায় সিংহের গর্জন শুনতে পাওয়া যায়–অদ্ভুত জীবন। ঠিক এই জীবনই সে চেয়েছিল। এ তার রক্তে আছে। এই জনহীন প্রান্তর, এই রহস্যমন্ত্রী রাত্রি, অচেনা নক্ষত্রে ভর আকাশ, এই বিপদের আশঙ্কা—এই তো জীবন! শাস্ত নিরাপদ জীবন নিরীহ কেরানীর জীবন হতে পারে—তার নয়— সেদিন বিকেলের ট্রেন রওনা করে দিয়ে সে নিজের কোয়ার্টারের রান্নাঘরে ঢুকৃতে যাচ্ছে এমন সময়ে খুটির গায়ে কি একটা দেখে সে তিন হাত লাফ দিয়ে পিছিয়ে এল—প্রকাণ্ড একটা হলদে খড়িশ গোখরো তাকে দেখে ফণা উষ্ঠত করে খুটি থেকে প্রায় এক হাত বাইবে মুখ বাড়িয়েছে। আর দু সেকেণ্ড পরে যদি শঙ্করের চোখ সেদিকে পড়ত—তা হলে—না, এখন সাপটাকে মারবার কি করা যায় ? কিন্তু সাপট পরমুহূৰ্বে খুটি বেয়ে উপরে খড়ের চালের মধ্যে লুকিয়ে পড়ল। বেশ কাণ্ড বটে। ঐ ঘরে গিয়ে শঙ্করকে এখন ভাত রাধতে বসতে হবে । এ সিংহ নয় যে দরজা বন্ধ করে আগুন জেলে রাখবে। খানিকটা ইতস্তত: করে শঙ্কর অগত্য রান্নাঘরে ঢুকল এবং কোনরকমে তাড়াতাড়ি রান্না সেরে সন্ধ্যা হবার আগেই খাওয়া-দাওয়া সাঙ্গ করে সেখান থেকে বেরিয়ে স্টেশন ঘরে এল। কিন্তু স্টেশন ঘরেই বা বিশ্বাস কি ? সাপ কখন কোন ফাক দিয়ে ঘরে ঢুকবুে, তাকে কি আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে?
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।