২৬৮ বিভূতি-রচনাবলী নিজেও একটা ধরালাম। লোকটার বাড়ী নাকি পাঁচ-ছ ক্রোশ দূরবর্তী একটি ক্ষুদ্র বন্য গ্রামে, বামুণ্ডী ও বালা শৈলমাল ও অরণ্যের মধ্যবর্তী কোন নিভৃত ছায়াগহন উপত্যকাভূমিতে পলাশ, মহুয়া, বট, কেঁদ গাছের তলায়। ওর আর দুটি সস্তান হয়ে মারা যাওয়ার পরে এই মেয়েটি হয় এবং মেয়েটির বয়স যখন দু’বছর, তখন তার মাও হ’ল মৃত্যুপথযাত্রী। লোকটা জঙ্গলের কাঠ ভেঙে এনে চন্দনকিয়ারীর হাটে বিক্রি করতো এদেশের অনেক গ্রাম্যলোকের মতো। কিন্তু ঘরে কেউ নেই দু’বছরের মেয়েকে দেখবার, তাকে সঙ্গে নিয়ে উচ্চ পাহাড়ে উঠে রেীন্দ্র ও বর্ষায় কি করে কাঠ ভাঙে ? তাই ঘরে আগড় বন্ধ করে ও চলে গিয়েছিল অর্থ উপার্জনের চেষ্টায় পুরুলিয়া শহরে । আমি বললাম, “কাঠের কাজে আয় হ’ত কেমন ?” লোকটা বিড়িতে টান দিয়ে বললে, “বোঝা পিছু তিন আনা, চার আনা । জঙ্গলে ছাড় লিত দু’পয়সা। চাল ছন্ত ছিলি। ইইয়ে যেতো পেটের ভাত ছ'জনার । তারপর বাবু মেয়াটা হোলেক্, ওর মা মর্যা গেলেক । তখন কচি মেয়াটারে ফেলে জঙ্গলে যেতে মন নাই সরলেকৃ। বলি ঘাই পুরুলিয়া, ভারি শহর, পেটের ভাত দু'জনার হইয়ে যাবেকৃ।” “পুরুলিয়া বড় জায়গা ?” *ও বাবু, ইধার থিকে উধার খাওয়ার কুল-কিনারা দু’বছরে নাই পাইলেক। ভারি শহর বাবু” আমি ওকে আর একটা বিড়ি দিলাম। গল্প জমে উঠেচে । বললাম,— *তারপর•••?” তারপর পুরুলিয়া শহরে কি ভাবে গেল, তার গল্প করলে। ওদের পাশের গায়ের একজন লোক পুরুলিয়া শহরে কি একটা কাজ করে, তার ঠিকানা খুজে বার করতে দিন কেটে গেল । সন্ধ্যা হয়েছে, তখন এক বড়লোকের বাড়ীর ফটকে মেয়ের হাত ধরে ভিক্ষে করতে দাড়ালো । তারা দুটি পয়সা দিলে, দু’পয়সার ছোলা কিনে বাপ-মেয়েতে রাত কাটিয়ে দিলে গাছতলায় শুয়ে। পুলিলে আবার শুতে দেয় না ; অৰ্দ্ধেক রাত্রে এসে লন্ঠনের আলো ফেলে বলে, “হিয়াসে হঠ, যাও ।” তার পরদিন আলাপী লোকের সন্ধান মিললো। গিয়ে দেখে দেশে সে লোকট যত বড়াই করে, আসলে সে তত বড় নয়। সামান্ত একটা দু-কামরা ঘরে সে আর তার স্ত্রী থাকে—তামাক মেখে বিক্রি করে মাথায় নিয়ে, কখনো জলের কুঁজে পাইকেরি দরে কিনে ফিরি করে খুচরো বেচে—এই সব উদ্ধবৃত্তি। অথচ দেশে বলেছিল সে বড় সাহেবের আরদালি । যাহোক, অনেক বলী-কওয়াতে সে জায়গা একটু দিলে—ঘরের বাইরের দাওয়ার একপাশে শুয়ে থাকতে হবে, তবে নিজের এনে খাওয়া-দাওয়া, তার ভার সে নেবে না। বছর দুই সেখানেই থেকে চলেছিল য; হয় একরকম—তারপর এই অকাল পড়লো, চালের জাম চড়লে—শহরে চালের দাম হ’ল আঠারো টাকা । ভিক্ষে আর তেমন লোকে দিতে চায় মা—তাও হয়তো চলতো বা হয় করে, কিন্তু যাদের বাড়ীতে থাকা তারা গোলমাল করতে লাগলো। তারা আর জায়গা দিতে চায় না, বলে, “আমাদের লোক আসবে, বাড়ী ছেড়ে
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৮১
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।