২৮৪ বিভূতি-রচনাবলী পেয়ে সেদিন ওরা তাই ধরেছিল । ছোট-ছোট-লাল কাকড়া। --তারপর ? —দু-জন বাদে বাকি সব সেই রাঞ্জে মারা গেল। বাবুজী, সে রাতের কথা ভাবলে এখনও ভয় হয় । সতেরো জন দিশি লস্কর আর দু-জন ওলন্দাজ সাহেব—একজন মেট আর একজন ইঞ্জিনীয়ার— সেই রাত্রে সাবাড়। রইলাম বাকি কাপ্তান আর আমি । তারপর জাহাজের কাপ্তান ওকে বললে—মড়াগুলো টান দিয়ে ফেলে দাও জলে— ও বললে—আমি মুৰ্দ্দাফরাশ নই সাহেব, ও আমি ছোব ন— সাহেব ওকে গুলি করে মারতে এল । ও গিয়ে লুকোলে ডেকের ঢাকনি খুলে হোল্ডের মধ্যে। সেই রাত্রে কাপ্তান সাহেব খুব মদ খেয়ে চিৎকার করে গান গাইছে—ও সেই সময় জাহাজের বোট খুলে নিয়ে নামতে গেল। ডেভিট থেকে বোট নামাবার শব্দে সাহেবের মদের নেশা ভাঙল না তাই নিস্তার--ডেকের ওপরে তখন দুটো মড় পড়ে রয়েছে—মরণের বীজ জাহাজের সর্বত্র ছড়ানো, ভয়ে ও কিছু খায় নি সকাল থেকে, পাছে কলেরা হয় । সুতরাং অনাহারে ও ভয়ে খানিকটা দুৰ্ব্বলও হয়ে পড়েছে । দূরে ডাঙা দেখা যাচ্ছিল, দুপুরের দিকে ও লক্ষ্য করেছিল। সারা রাত নৌকো বাইবার পরে ভোরে এসে বোট ডাঙায় লাগল । ও নেমে দেখে ডাঙায় ভীষণ জঙ্গল—ওদেশের সব দ্বীপেই এ ধরনের জঙ্গল ও জানত। লোকজনের কোন চিহ্ন নেই কোনদিকে । বোট ডাঙায় বেঁধে ও জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দু-দিন হাঁটলে, শুধু গাছের কৃচি পাতা আর এক ধরনের অম্ল-মধুর ফল খেয়ে। মানুষের বসতির সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় এসে হঠাৎ একেবারে ও অবাক হয়ে গেল । ওর সামনে প্রকাও বড় সিংহদরজা—কিন্তু বড় বড় লতাপাত উঠে একেবারে ঢেকে ফেলে দিয়েছে। সিংহদরজার পর একটা বড় পাচিলের খানিকটা—আরও খানিক গিয়ে একটা বড় মন্দির, তার চুড়ো ভেঙে পড়েছে-মন্দিরের গায়ে হিন্দু দেবদেবীর মূৰ্ত্তি বলে তার মনে হল। লে ভারতের লোক, হিন্দু দেবদেবীর মূৰ্ত্তি সে চেনে। এ ক্ষেত্রে হয়ত সে ঠিক চিনতে পারে নি—তবে তার ওইরকম বলেই মনে হয়েছিল। অবাক হয়ে সে আরও ঘুরে ঘুরে দেখলে ৷ জায়গাটা একটা বহুকালের পুরোনো শহরের ভগ্নস্তৃপ মনে হল। কত মন্দির, কত ঘর, কত পাথরের সিংদরজ, গভীর বনের মধ্যে বড় বড় কাছির মত লতার নাগপাশ-বন্ধনে জড়িয়ে কত যুগ ধরে পড়ে আছে। ভীষণ বিষধর সাপের জাড়া সৰ্ব্বত্র। একটা বড় ভাঙা মন্দিরে সে পাথরের প্রকাও বড় মূতি দেখেছিল—প্রায় আট দশ হাত উচু। সন্ধ্যা আসবার আর বেশি দেরি নেই দেখে তার বড় ভয় হয়ে গেল। এ সব প্রাচীন কালের নগর শহর—জিন পরীর আডড, তেলেগু লস্করেরা স্বাকে ওদের ভাষায় বলে “বিন্ধমুনি"।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/২৯৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।