হীরামানিক জলে ২৮৯ নিজের প্রাণ বিপন্ন করে, সামান্ত কিছু পাথর ছাড়া সে বেশি কোন জিনিস আনতে পারে নি সেখান থেকে। তার নিজের লেখা জাহাজের লগবুকের ( Log Book ) কয়েকখানা পাতা আমি মালয় ভাষা থেকে নিজের সুবিধার জন্যে ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে নিই সোঁৱাবায়াতে এক গরীব মালয় স্কুল মাস্টারকে ধরে। সেই অনুবাদের কাগজখানাও এই ব্যাগের মধ্যে আছে। তারপর ম্যাপখানা হস্তগত করে আমি নিজে অনেক খোজাখুজি করি—কিন্তু স্বলু সমুদ্রেরও ওদিকে বহুশত বসতিহীন ও বসতিযুক্ত ছোট ও বন্ড দ্বীপ-তাদের প্রত্যেকটিতে ভীষণ জঙ্গল। ম্যাপও যা আছে, তা খুব নিখুত নয়—মোটের ওপর সে দ্বীপ আমি বার করতে পারিনি। দেশের গ্রামে আমার ছেলে আছে, তাকে নিয়ে গিয়ে ম্যাপটা আর ব্যাগ দিও । এর মধ্যে আর একটা জিনিস আছে—আমার বোম্বেটে বন্ধু সেই প্রাচীন শহরে একটা জিনিস পায়। জিনিসটা একটা সীলমোহর বলেই মনে হয়। একখান গোট পদ্মরাগ মণির ওপর সীলমোহরটা খোদাই করা । সেটাও এর মধ্যে আছে। সেই মোহরের ওপরে ষে অদ্ভুত চিহ্নটি আঁকা আছে—আমার বিশ্বাস ছিল, সেটা একটা বড় হদিস ওই প্রাচীন নগরীর রত্নভাণ্ডারের। তাই ওখান আমি কবচের মত গলায় ঝুলিয়ে বেড়িয়েছি এতদিন । কিন্তু আজ বুঝেছি আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে । উনিশ বছর আগে গ্রাম থেকে যখন চলে আসি, তখন আমার ছেলে ছিল দু-বছরের—আর আমার স্ত্রী-পুত্রকে দেখিনি এই উনিশ বছরের মধ্যে। বেঁচে থাকলে আজ সে একুশ-বাইশ বছরের যুবক । তার হাতে এগুলো সব দিয়ে বলে দিও, বাপের ছেলে যদি হয়, সে যেন খুঁজে বার করে সেই নগরী, তার বাপ যা পারেনি। আর আমার কিছু বলবার নেই। ব্যাগটা নাও হাতে তুলে । রোগী এই পৰ্য্যন্ত বলে ক্লাস্তিতে চোখ বুজলে । চীনা আডডাধারীর ইঙ্গিতে ও রোগীর ঘর থেকে বেরিয়ে এল । সুশীল বললে—তারপর ? —বাবুজি, যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম, নটরাজন বঁাচল কি মারা গেল সেদিকে কোন খেয়াল করিনি। আমার মাথা তখন ঘুরছে। ব্যাগ খুলে দেখলাম কতকগুলো পুরোনো কাগজপত্র ও ম্যাপখানা ছাড়া আর কিছুই নেই। পদারাগ মণিটা নেড়ে-চেড়ে দেখে কিছু বুঝলাম না-ওসব জিনিসের আমরা কী বুঝি বলুন ! কিন্তু তখন আমার আর একটা বড় কথা মনে হয়েছে। নটরাজন যখন ওর গল্প করছিল, আমার মনে পড়ল সাত বছর আগের সেই ঘটনা। জাহাজে সেই কলেরা হওয়া, আমার জাহাজ থেকে পালানো এবং বন জঙ্গলের মধ্যে সেই বিন্ধমুনির দেশের মধ্যে গিয়ে পড়া, বুঝলেন না বাবুজি ? —খুব বুঝেচি, বলে যাও । —আমার মনে হল, আমি সেখানেই গিয়ে পড়েছিলাম ঘুরতে ঘুরতে । সে পুরোনো শহর আমি দেখেছি, নটরাজন যা বের করতে পারে নি। আমি সেখানে একটা গোটা দিন কাটিয়েচি। এই জায়গা স্বলুসী-র ধারে, তাও আমি জানি। যদিও ঠিক বলতে পারব না হয়ত—কিন্তু দূর থেকে দেখলে বোধ হয় চিনব।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৩০২
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।