হীরামানিক জ্বলে ৩২৯ করে কঁপিতে কঁপিতে বললে—আমায় মাপ করুন, আমি এর আগে দেখি নি আপনাকে । আমি স্বীকার করছি আমার ভুল হয়েছে। আমি ভুল শুধরে নেব— শয়তান হাসতে হাসতে বললে—তাই শুধরে নাও গে যাও—নইলে তোমার কান মলে দেব— যাক। ওরা সবাই খিলানের তলা দিয়ে অগ্রসর হয়ে মন্দিরের মধ্যেকার প্রাঙ্গণে এসে দাড়াল। শুধু ভীষণ কাটাগাছ আর বেত, যা থেকে মলঙ্কা বেতের ছড়ি হয় । সনৎ ছেলেমাহধ, ভাল বেত দেখে বলে উঠল—দাদা, একটা বেত কাটব ? ইয়ার হোসেন তাকে ধমক দিয়ে কি বলতে যাচ্ছে, এমন সময় একটি স্বন্দর পাখি এসে সামনের বন্ত রবারের গাছের ডাল থেকে মন্দিরের ভাঙা পাথরের কানিসে বসল। সবাই ই করে চেয়ে রইল পাখিটার দিকে। কী স্বন্দর । দীর্ঘ পুচ্ছ ঝুলে পড়েছে কানিস থেকে প্রায় এক হাত—ময়ূরের পুচ্ছের মত। হলদে ও সাদা জাখি পালকের গায়ে–পিঠের পালকগুলো ঈষৎ বেগুনি । ইয়ার হোসেন বললে—টিকাটুরা, যাকে সাহেব লোক বলে বার্ড অব প্যারাডাইজ—খুব স্বলক্ষণ । সনৎ বললে—বাঃ, কী চমৎকার! এই সেই বিখ্যাত বার্ড অব প্যারাডাইজ ! কত পড়েছি ছেলেবেলায় এদের কথা— স্বশীল বললে—স্বলক্ষণ কুলক্ষণ দুরকমই দেখছি। কুমির নিলে একজনকে, আবার বার্ড অব, প্যারাডাইজ দেখা গেল এটা স্বলক্ষণ— মন্দিরের বিভিন্ন কুঠরি । প্রত্যেক কুঠরির দেওয়ালে সারবন্দী খোদাই কাজ। স্বশীল একখানা পাথরের ইট মনোযোগের সঙ্গে দেখলে। একজন ভারতবর্ষীয় হিন্দু রাজ সিংহাসনে উপবিষ্ট, তার পাশে বোধহয় গ্রহবিপ্র পজি পড়ছেন । সামনে একসার লোক মাথা নিচু করে যেন রাজাকে অভিবাদন করছে। রাজার এক হাতে একটা কী পাখি—হয় পোষা শুক, নয়ত শিক্রে বাজ । > ভারত। ভারত! কত মিষ্টি নাম, কী প্রাচীন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অমূল্য ভাণ্ডার । তার নিজের দেশের মানুষ একদিন কম্পাস-ব্যারোমিটারহীন যুগে সপ্ত সমূত্রে পাড়ি দিয়ে এখানে এসে হিন্দুধর্মের নিদর্শন রেখে গিয়েছিল, তাদের হাতে গড় এই কীৰ্ত্তির ধ্বংসস্তুপে দাড়িয়ে গৰ্ব্বে ও আনন্দে স্বশীলের বুক ফুলে উঠল। বীর তারা, দুৰ্ব্বল হাতে আসি ও বর্শ ধরে নি, ধন্থকে জ্যা রোপণ করে নি—সমূদ্র পাড়ি দিয়েছে—এই অজ্ঞাত বিপদসঙ্কুল মহাসাগর—হিন্দুধর্মের জয়ধ্বজ উড়িয়ে দিগ্বিজয় করে নটরাজ শিবের পাষাণ-দেউল তুলেছে সপ্তসমূদ্র-পারে। পরবর্তী যুগের ধারা স্থতিশাস্ত্রের বুলি আউড়ে টোলের ভিটেয় বাশবনের অন্ধকারে বসে বলে গিয়েছিল—সমূত্রে ঘেও না, গেলে জাতটি একেবারে যাবে, হিন্দুত্ব একেবারে লোপ পাবে, —তারা ছিল গৌরবময় যুগের বীর পূর্বপুরুষদের অধোগ্য বংশধর, তাদের স্বায়ু দুৰ্ব্বল, মন দুৰ্ব্বল, দৃষ্টি ক্ষীণ, কল্পনা স্থবির।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৩৪২
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।