পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চাদের পাহাড় Vඋළු পিস্তল ফেলে দিবি—এক—দুই—তিন— আলবুকার্কের শিথিল হাত থেকে পিস্তলট মাটিতে পড়ে পেল। আলভারেজ বললে-বালককে এক পেয়ে খুব বীরত্ব জাহির করছিলি, না ? শঙ্কর ততক্ষণ পিস্তলটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে। আলবুকার্ক একটু বিস্মিত হল, আলভারেজ যে শঙ্করের দলের লোক তা সে ভাবেও নি। সে হেসে বললে—আচ্ছা মেটু, কিছু মনে কোরো না, আমারই হার। দাও আমার পিস্তলটা দাও ছোকৃর। কোনো ভয় নেই, দাও। এসে হাতে হাত দাও। তুমিও মেঢ়। আল্‌বুকার্ক রাগ পুষে রাপে না। এসে কাছেই আমুরে কেনিন, এক গ্লাস বিয়ার খেয়ে যাও। আলভারেজ নিজের জাতের লোকের রক্ত চেনে। ও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে শঙ্করকে সঙ্গে নিয়ে আলবুকার্কের কেবিনে গেল। শঙ্কর বিয়ার খায় না শুনে তাকে কফি করে দিলে। প্রাণ-খোলা হাসি হেসে কত গল্প করলে, যেন কিছুই হয় নি। শঙ্কর বাস্তবিকই লোকটার দিকে আকৃষ্ট হল। কিছুক্ষণ আগের অপমান ও শক্ৰত যে এমন বেমালুম ভুলে গিয়ে, যাদের হাতে অপমান হয়েছে তাদেরই সঙ্গে এমনিধারা দিলখোলা হেসে খোশগল্প করতে পারে, পুথিবীতে সে ধরনের লোক বেশী নেই । পরদিন ওরা কাবালো থেকে মারে উঠল কঙ্গোনদী বেয়ে দক্ষিণমুখে যাবার জন্যে। নদীর দুই তীরের দৃশ্বে শঙ্করের মন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। এরকম অদ্ভুত বনজঙ্গলের দৃপ্ত জীবনে কখনো সে দেখে নি। এতদিন সে যেখানে ছিল, আফ্রিকার সে অঞ্চলে এমন বন নেই—সে শুধু বিস্তীর্ণ প্রাস্তর, প্রধানত: ঘাসের বন, মাঝে মাঝে বাবলা ও ইউকা গাছ। কিন্তু কঙ্গোনদী বেয়ে ষ্টীমার যত অগ্রসর হয়, দুধারে নিবিড় বনানী, কত ধরনের মোটা মোটা লতা, বনের ফুল ; বন্যপ্রকৃতি এখানে আত্মহারা, লীলাময়ী, আপনার সৌন্দর্ঘ্যে ও নিবিড় প্রাচুর্য্যে আপনি মুগ্ধ। শঙ্করের মধ্যে যে সৌন্দৰ্য্যপ্রিয় ভাবুক মনটি ছিল, (হাজার হোকৃ সে বাংলার মাটির ছেলে, ডিয়েগো আলভারেজের মত শুধু কঠিনপ্রাণ স্বর্ণাম্বেষী প্রসপেক্টর নয়) এই রূপের মেলায় সে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে রাঙা অপরাহ্লে ও দুপুর রোদে আপন মনে কত কি স্বপ্নজাল রচনা করে। অনেক রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, অচেনা তারাভর বিদেশের আকাশের তলায় রহস্যময়ী বন্য প্রকৃতি তখন যেন জেগে উঠেছে--জঙ্গলের দিক থেকে কত বন্যজন্তুর ডাক কানে আসে, শঙ্করের চোখে ঘুম নেই, এই সৌন্দৰ্য্য-স্বপ্নে ভোর হয়ে, মধ্য আফ্রিকার নৈশ শীতলতাকে তুচ্ছ করেও জেগে বসে থাকে। ঐ জলজলে সপ্তর্ষিমণ্ডল—আকাশে অনেক দূরে তার ছোট গ্রামের মাথায়ও আজ এমনি সুপ্তর্ষিমণ্ডল উঠেছে, ওই রকম এক ফালি কৃষ্ণপক্ষের গভীর রাত্রির চাদও। সে-সব পরিচিত আকাশ ছেড়ে কতদূরে সে এসে পড়েছে, আরও কতদূরে তাকে যেতে হবে, কি এর পরিণতি কে জানে ?