e8 বিভূতি-রচনাবলী দুদিন পরে বোট এসে সানকিনি পৌছলো। সেখান থেকে ওরা আবার পদব্রজে রওনা হল—জঙ্গল এদিকে বেশী নেই, কিন্তু দিগন্তপ্রসারী জনমানবহীন প্রান্তর ও অসংখ্য ছোট বড় পাহাড়, অধিকাংশ পাহাড় রুক্ষ ও বৃক্ষশূন্য, কোনো কোনো পাল্লাড়ে ইউফোবিয়া জাতীয় গাছের ঝোপ। কিন্তু শঙ্করের মনে হল, আফ্রিকার এই অঞ্চলের দৃশ্ব বড় অপরূপ। একটা ফাক জায়গা পেয়ে মন যেন হাফ ছেড়ে বাচে, স্বৰ্য্যান্তের রঙ, জ্যোংস্কারাত্রির মায়া এই দেশকে রাত্রে, অপরাহ্লে রূপকথার পরীরাজ্য করে তোলে। আলভারেজ বললে—এই ভেল্ড অঞ্চলে সব জায়গা দেখতে একরকম বলে পথ হারাবার সম্ভাবনা কিন্তু খুব বেশী। কথাটা যেদিন বলা হল, সেদিনই এক কাণ্ড ঘটল। জনহীন ভেল্ডে স্থৰ্য্য অস্ত গেলে ওরা একটা ছোট পাহাড়ের আড়ালে তাবু খাটিয়ে আগুন জাললে – শঙ্কর জল খুজতে বেরুল । সঙ্গে আলভারেজের বন্দুকটা নিয়ে গেল, কিন্তু মাত্র দুটি টোটা। আধঘণ্টা এদিক ওদিক ঘুরে বেলাটুকু গেল, পাতলা অন্ধকারে সমস্ত প্রান্তরকে ধীরে ধীরে আবৃত করে দিলে। শঙ্কর শপথ করে বলতে পারে, সে আধঘণ্টার বেশী হাটে নি। হঠাৎ চারিধারে চেয়ে শঙ্করের কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হল, যেন কি একটা বিপদ আসছে, তাবুতে ফেরা ভালো। দূরে দূরে ছোট-বড় পাহাড়, একই রকম দেখতে সব দিক, কোনো চিহ্ন নেই, সব একাকার। মিনিট পাঁচ-ছয় হাটবার পরই শঙ্করের মনে হল সে পথ হারিয়েছে। তখন আল্ভারেজের কথাটা তার মনে পড়ল। কিন্তু তখনও সে অনভিজ্ঞতার দরুন বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলে না। হেঁটেই যাচ্ছে—একবার মনে হয় সামনে, একবার মনে হয় বায়ে, একবার মনে হয় ডাইনে। র্তাবুর আগুনের কুণ্ডট দেখা যায় না কেন ? কোথায় সেই ছোট পাহাড়টা ? দু-ঘণ্টা হাটবার পরে শঙ্করের খুব ভয় হল। ততক্ষণে সে বুঝেছে যে, সে সম্পূর্ণরূপে পথ হারিয়েছে এবং ভয়ানক বিপদগ্রস্ত। একা তাকে রোডেসিয়ার এই জনমানবশূন্য, সিংহসন্ধুল অজানা প্রান্তরে রাত কাটাতে হবে,—অনাহারে এবং এই কনকনে শীতে বিনা কম্বলে ও বিনা আগুনে। সঙ্গে একটা দেশলাই পৰ্য্যস্ত নেই। ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই দাড়ালে যে, পরদিন সন্ধ্যার পূৰ্ব্বে অর্থাৎ পথ হারানোর চব্বিশ ঘণ্টা পরে, উদ্ৰান্ত, তৃষ্ণায় মুম্মু শঙ্করকে ওদের তাবু থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে একটা ইউফোবিয়া গাছের তলা থেকে আলভারেজ উদ্ধার করে তাবুতে নিয়ে এল। আলভারেজ বললে—তুমি যে পথ ধরেছিলে শঙ্কর, তোমাকে আজ খুজে বার করতে না পারলে তুমি গভীর থেকে গভীরতর মরুপ্রাস্তরের মধ্যে গিয়ে পডে কাল দুপুর নাগাদ তৃষ্ণায় প্রাণ হারাতে। এর আগে তোমার মত অনেকেই রোডেসিয়ার ভেল্ডে এভাবে মারা গিয়েছে। এ-সব ভয়ানক জায়গা। তুমি আর কখনও তাবু থেকে ওরকম বেরিও না, কারণ তুমি আনাড়ী। মরুভূমিতে ভ্রমণের কৌশল তোমার জানা নেই। ডাহা মারা পড়বে। শঙ্কর বললে—আলভারেজ, তুমি দুবার আমার প্রাণরক্ষা করলে, এ আমি ভূলবে না। আলভারেজ বললে—ষ্টয়াং ম্যান ভূলে ঘাচ্ছ যে, তার আগে তুমি আমার প্রাণ বঁচিয়েছ।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৪৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।