88 বিভূতি-রচনাবলী ওপর একটা পায়ের দাগ—লম্বায়ু দাগটা এগারো ইঞ্চির কম নয়, কিন্তু তিনটে মাত্র পায়ের আঙুল। তিন আঙুলেরই দাগ বেশ স্পষ্ট। পায়ের দাগ ধরে সে এগিয়ে গেল—আরও অনেকগুলো সেই পায়ের দাগ আছে, সবগুলোতেই সেই তিন আঙুল। শঙ্করের মনে পড়ল ইউগাণ্ডার স্টেশন ঘরে আলভারেজের মুখে শোনা জিম্ কার্টারের মৃত্যুকাহিনী। গুহার মুখে বালির ওপর সেই অজ্ঞাত হিংস্ৰ জানোয়ারের তিন আঙুলওয়ালা পায়ের দাগ। কাফির গ্রামের সর্দারের মুখে শোনা গল্প। আলভারেজের কাল রাত্রের বিবর্ণ মুখও সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। আর একদিনও আলভারেজ ঠিক এই রকমই ভয় পেয়েছিল, যেদিন পৰ্ব্বতের পাদমূলে ওরা প্রথম এসে তাবু পাতে । বুনিপ ! কাফির সর্দারের গল্পের সেই বুনিপ । রিখটারস্ভেল্ড পৰ্ব্বত ও অরণ্যের বিভীষিকা, যার ভয়ে শুধু অসভ্য মানুষ কেন, অন্য কোনো বন্য জন্তু পৰ্য্যন্ত এই আট হাজার ফুট ওপরকার বনে আসে না। কাল রাত্রে কোনো জানোয়ারের শব্দ পাওয়া যায় নি কেন, এখন তা শঙ্করের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আল্ভারেজ পর্য্যস্ত ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল ওর গলার শব্দ শুনে। বোধ হয় ও শব্দের সঙ্গে আল্ভারেজের পূর্ব পরিচয় ঘটেছে। আলভারেজের ঘুম ভাঙতে সেদিন দেরি হল । গরম কফি এবং গরম কিছু খাদ্য গলাধঃকরণ করবার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার সেই নিৰ্ভীক ও দুৰ্দ্ধৰ্ষ আলভারেজ, যে মানুষকেও ভয় করে না, শয়তানকেও না। শঙ্কর ইচ্ছে করেই আলভারেজকে ঐ অজ্ঞাত জানোয়ারের পায়ের দাগটা দেখালে না—কি জানি যদি আলভারেজ বলে বসে—এখনও পাহাড়ের স্তাড়ল পাওয়া গেল না, তবে নেমে যাওয়া যাকৃ! সকালে সেদিন খুব মেঘ করে ঝম্ ঝম্ করে বৃষ্টি নামলে। পৰ্ব্বতের ঢালু বেয়ে যেন হাজার ঝরনার ধারায় বৃষ্টির জল গড়িয়ে নীচে নামছে । এই বন ও পাহাড় চোখে কেমন যেন ধধি লাগিয়ে দেয়, এতটা উঠেছে ওরা কিন্তু প্রতি হাজার ফুট ওপর থেকে নীচের অরণ্যের গাছপালার মাথা দেখে সেগুলিকে সমতলভূমির অরণ্য বলে ভ্রম হচ্ছে—কাজেই প্রথমটা মনে হয় যেন কতটুকুই বা উঠেছি, ঐটুকু তো । বৃষ্টি সেদিন থামলে না—বেলা দশটা পৰ্য্যস্ত অপেক্ষা করে আলভারেজ, ওঠবার হুকুম দিলে। শঙ্কর এটা আশা করে নি। এখানে শঙ্কর কৰ্ম্মী শ্বেতাঙ্গচরিত্রের একটা দিক লক্ষ্য করলে। তার মনে হচ্ছিল, কেন এই বৃষ্টিতে মিছে মিছে বার হওয়া ? একটা দিনে কি এমন হবে ? বৃষ্টি-মাথায় পথ চলে লাভ ? অবিশ্রাস্ত বৃষ্টিধারার মধ্যে ঘন অরণ্যানী ভেদ করে সেদিন ওরা সারাদিন উঠল। উঠছে, উঠছে, উঠছেই—শঙ্কর অার পারে না। কাপড়-চোপড় জিনিসপত্র, তাবু সব ভিজে একৃশ, একখানা রুমাল পর্য্যন্ত শুকনো নেই কোথাও—শঙ্করের কেমন একটা অবসাদ এসেছে দেহে ও মনে—সন্ধ্যার দিকে যখন সমগ্ৰ পৰ্ব্বত ও অরণ্য মেঘের অন্ধকারে ও সন্ধ্যার অন্ধকারে
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৫৭
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।