চাদের পাহাড় 8& একাকার হয়ে ভীমদৰ্শন ও গম্ভীর হয়ে উঠল, ওর তখন মনে হল—এই অজান দেশে অজানা পৰ্ব্বতের মাথায় ভয়ানক হিংস্ৰজন্তুসফুল বনের মধ্যে দিয়ে, বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়, কোন অনিৰ্দ্দেপ্ত হীরকখনি বা তার চেয়েও অজানা মৃত্যুর অভিমুখে সে চলেছে কোথায়? আলভারেজ কে তার ? তার পরামর্শে কেন সে এখানে এল ? হীরার খনিতে তার দরকার নেই। বাংলা দেশের খড়ে ছাওয়া ঘর, ছায়াভরা শান্ত গ্রাম্য পথ, ক্ষুদ্র নদী, পরিচিত পাপীদের কাকলী— সে-সব যেন কতদূরের কোন অবাস্তব স্বপ্ন-রাজ্যের জিনিস, আফ্রিকার কোনো হীরকখনি তাদের চেয়ে মূল্যবান নয়। কিন্তু তার এ ভাব কেটে গেল অনেক রাত্রে, যখন নিৰ্ম্মেঘ আকাশে চাদ উঠল। সে অপার্থিব জ্যোৎস্নাময়ী রজনীর বর্ণনা নেই। শঙ্কর আর পৃথিবীতে নেই, বাংলা বলে কোনো দেশ নেই। সব স্বপ্ন হয়ে গিয়েছে—সে আর কোথাও ফিরতে চায় না, হীরা চায় না - পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বহু উৰ্দ্ধে এক কৌমুদী-শুভ্র দেবলোকের এখন সে অধিবাসী, তার চারিধারে ষে সৌন্দৰ্য্য, কোনো মানুষের চোখ এর আগে তা কখনো দেখে নি। সে গহন নিস্তব্ধতা, এর আগে কোনো মানুষ অনুভব করে নি। জনমানবহীন বিশাল রিখটারস্ভেল্ড, পৰ্ব্বত ও অরণ্য এই গভীর নিশীথে মেঘলোকে আসন পেতে আপনাতে আপনি আত্মস্থ, ধ্যানস্তিমিত—পৃথিবীর মানুষের সেখানে প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য কচিৎ ঘটে। সেই রাত্রে ঘুম থেকে ও ধড়মড়িয়ে উঠল আলভারেজের ডাকে। আলভারেজ ডাকছে— শঙ্কর, শঙ্কর, ওঠে বন্দুক বাগাও। -कि-दिতার পর ও কান পেতে শুনলে—তাবুর চারিপাশে কে যেন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার জোর নিঃশ্বাসের শব্দ বেশ শোনা যাচ্ছে র্তাবুর মধ্যে থেকে। চাদ ঢলে পড়েছে, তাবুর বাইরে অন্ধকারই বেশী, জ্যোৎস্নাটুকু গাছের মগডালে উঠে গিয়েছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। র্তাবুর দরজার মুখে আগুন তখনও একটু একটু জলছে—কিন্তু তার আলোর বৃত্ত যেমন ছোট, আলোর জ্যোতিও ততোধিক ক্ষীণ, তাতে দেখবার সাহায্য কিছুই হয় না। হুড় মুড় করে একটা শব্দ হল—গাছপালা ভেঙে একটা ভারী জানোয়ার হঠাৎ ছুটে পালালে যেন। যেন তাবুর সকলে সজাগ হয়ে উঠেছে, এখন আর অতর্কিত শিকারের স্ববিধে হবে না, বাইরের জানোয়ারটা তা বুঝতে পেরেছে। জানোয়ারটা ঘাই হোক না কেন, তার যেন বুদ্ধি আছে, বিচারের ক্ষমতা আছে, মস্তিষ্ক আছে । আলভারেজ রাইফেল হাতে টর্চ জেলে বাইরে গেল। শঙ্করও গেল ওর পেছনে পেছনে। টর্চের আলোয় দেখা গেল, তাবুর উত্তর-পূর্ব কোণের জঙ্গলের চার গাছপালার ওপর দিয়ে যেন একটা ভারী স্ট্রম রোলার চলে গিয়েছে। আল্ভারেজ সেই দিকে বন্দুকের নল উচিয়ে বার দুই দ্যাওড় করলো । কোনো দিকে কোনো শব্দ পাওয়া গেল না ।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৫৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।