চাদের পাহাড় 8% চার-পাঁচশো ফুট নেমে গেল এক মাইলের মধ্যে, সুতরাং বেশ তুরারোহ—যতটুকু সমতল, ততটুকু শুধুই বড় বড় বনস্পতির জঙ্গল, ইরিথি না, পেনসিয়ানা, রিড়াগাছ, বাশ, বন্য আদ। বিচিত্র বর্ণের অকিডের ফুল ডালে ডালে। বেবুন ও কলোবাস বানর সর্বত্র। আরও দুদিন ধরে ক্রমাগত নামতে নামতে ওরা রিখটারসভেন্ড পর্বতের আসল রেঞ্জের ওপারের উপত্যকায় গিয়ে পদার্পণ করলো। শঙ্করের মনে হল, এদিকে জঙ্গল যেন আরও বেশী দুর্ভেদ্য ও বিচিত্র । আটলান্টিক মহাসাগরের দিক থেকে সমুদ্রবাষ্প উঠে কতক ধাক্কা খায় পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুন পৰ্ব্বতে, বাকিটা আটকায় বিশাল রিখটারসভেল্ডের দক্ষিণ সাহতে—মৃতরাং বৃষ্টি এখানে হয় অজস্ৰ, গাছপালার তেজও তেমনি। দিন পনেরো ধরে সে বিরাট অরণ্যাকীর্ণ উপত্যকাব সৰ্ব্বত্র দুজনে মিলে খুজেও আলভারেজ বর্ণিত পাহাড়ী নদীর কোনো ঠিকানা বার করতে পারলে না। ছোটখাটে৷ ঝরনা দু একটা উপত্যকার ওপর দিয়ে বইছে বটে—কিন্তু আলভারেজ কেবলই ঘাড় নাড়ে আর বলে—এসব নয় । শঙ্কর বলে—তোমার ম্যাপ দ্যাথো না ভালো করে ? কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, আলভারেজের ম্যাপের কোনো নিশ্চয়তা নেই। আল্ভারেজ বলে—ম্যাপ কি হবে ? আমার মনে গভীর ভাবে আঁকা আছে সে নদী ও সে উপত্যকার ছবি—সে একবার দেখতে পেলেই তখুনি চিনে নেবো । এ সে জায়গাই নয়, এ উপত্যকাই নয়। নিরুপায় । থোজো তবে । এক মাস কেটে গেল । পশ্চিম আফ্রিকায় বর্ষ নামল মাচ্চ মাসের প্রথমে । সে কী ভয়ানক বর্ষা ! শঙ্কর তার কিছু নমুনা পেয়ে এসেছে রিখটারসভেল্ড, পার হবার সময়ে । উপত্যক ভেসে গেল পাহাড় থেকে নানা বড় বড় পাৰ্ব্বত্য ঝরনার জলধারায়। র্তাবু ফেলবার স্থান নেই। একরাত্রে হঠাৎ অতিবর্ষণের ফলে ওদের তাবুর সামনে একটা নিরীহ ক্ষীণকায় ঝরনাধারা ভীমমূৰ্ত্তি ধারণ করে ওদের তাবুস্থদ্ধ ওদের স্বদ্ধ ভাসিয়ে নিয়ে যাবার যোগাড় করেছিল—আলভারেজের সজাগ ঘুমের জন্যে সে-যাত্রা বিপদ কেটে গেল। কিন্তু দিন যায় তো ক্ষণ যায় না। শঙ্কর একদিন ঘোর বিপদে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে । সে বিপদটাও বড় অদ্ভূত ধরনের। সেদিন আলভারেজ রাইফেল পরিষ্কার করছিল, সেটা শেষ করে রান্না করবে কথা ছিল । শঙ্কর রাইফেল হাতে বনের মধ্যে শিকারের সন্ধানে বার হয়েছে।“ আলভারেজ বলে দিয়েছে তাকে এ বনে খুব সতর্ক হয়ে সাবধানে চলাফেরা করতে— আর বন্দুকের ম্যাগাজিনে সব সময় যেন কার্টিজ ভরা থাকে। আর একটা খুব মূল্যবান উপদেশ দিয়েছে, সেটা এই—বনের মধ্যে বেড়াবার সময় হাতের কক্তিতে কম্পাস সৰ্ব্বদা বেঁধে নিয়ে বেড়াবে এবং যে পথ দিয়ে যাবে, সে পথের ধারে গাছপালায় কোনো চিহ্ন রেখে যাবে, যাতে ফেরবার সময় সেই সব চিহ্ন ধরে আবার ঠিক ফিরতে পারে। নতুবা বিপদ অবশুম্ভাবী।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৬০
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।