পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬২ বিভূতি-রচনাবলী আরস্থল, কি ইঁদুর, কি কাকড়াবিছে—কোনো জীব নেই গুহার মধ্যে যে সে ধরে খায় । মাথা ক্রমশ: অপ্রকৃতিস্থ হয়ে আসছে, তার জ্ঞান নেই সে কি করছে বা তার কি ঘটুছে— কেবল এইটুকু মাত্র জ্ঞান রয়েছে যে তাকে এ গুহা থেকে যে করে হোক বেরুতেই হবে, দিনের আলোর মুখ দেপতেই হবে। তাই সে অবসন্ন নির্জীব দেহেও অন্ধকারে হাতড়ে হাতডেই বেড়াচ্ছে, মরণের পূর্ব মুহূৰ্ত্ত পৰ্য্যন্ত ওইরকমই হাতড়াবে । একবার সে অবসন্ন দেহে ঘুমিয়ে পড়ল। কতক্ষণ পরে সে জেগে উঠল, তা সে জানে না ; দিন, রাত্রি, ঘণ্টা, দুগু, পল মুছে গিয়েছে এই ঘোর অন্ধকারে। হয়তো বা তার চোখ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েছে, কে জানে ? y ঘুমোবার পরে সে যেন একটু বল পেল। আবার উঠল, আবার চলল, আলভারেজের শিষ্য সে, নিশ্চেষ্ট ভাবে হাত-প। কোলে করে বসে কখনই মরবে না । সে পথ খুজিবে, খুজবে, যতক্ষণ বেঁচে আছে । আশ্চর্য্য, সে নদীটাই ব৷ কোথায় গেল ? -- গুহার মধ্যে গোলকধাধায় ঘোরবার সময়ে জলধারাকে সে কোথায় হারিয়ে ফেলেছে। নদী দেখতে পেলে হয়তে উদ্ধার পাওয়াও যেতে পারে, কারণ তার এক মুখ যেদিকেই থাকৃ, একটা মুখ আছে গুহার বাইরে । কিন্তু নদী তো দূরের কথ, একটা অতি ক্ষীণ জলধারার সঙ্গেও আজ তিন দিন পরিচয় নেই। জল অভাবে শঙ্কর মরতে বসেছে, কষ, লোনা, পিস্বাদ জল চেটে চেটে তার জিব ফুলে উঠেছে, তৃষ্ণ তাতে বেড়েছে ছাড়া কমে নি । পাথরের দেওয়াল হাতড়ে শঙ্কর খুজতে লাগল, ভিজে দেওয়ালের গায়ে কোথাও শেওল৷ জন্মেছে কি না—থেয়ে প্রাণ বাচাবে । না, তাও নেই ! পাথরের দেওয়াল সৰ্ব্বত্র অনাবৃত–মাঝে মাঝে ক্যালসিয়াম্ কাৰ্ব্বোনেটের পাতলা সর পড়েছে। একটা ব্যাঙের ছাতা, কি শেওলাজাতীয় উদ্ভিদও নেই । সূর্য্যের আলোর অভাবে উদ্ভিদ এখানে বঁাচতে পারে না । আরও একদিন কেটে রাত এল। এত ঘোরাঘুরি করেও কিছু সুবিধে হচ্ছে বলে তো বোধ হয় না। ওর মনে হতাশ ঘনিয়ে এসেছে। আরও সে কি চলবে, কতক্ষণ চলবে ? এতে কোনো ফল নেই, এ চলার শেষ নেই। কোথায় সে চলেছে এই গাঢ় নিৰুষকৃষ্ণ অন্ধকারে, এই ভয়ানক নিস্তব্ধতার মধ্যে ! উঃ, কি ভয়ানক অন্ধকার, আর কি ভয়ানক নিস্তব্ধতা ! পৃথিবী যেন মরে গিয়েছে, স্বষ্টিশেষের প্রলয়ে সোমস্থৰ্য্য নিভে গিয়েছে, সেই মৃত পৃথিবীর জনহীন, শব্দহীন, সময়হীন শ্মশানে সে-ই একমাত্র প্রাণী বেঁচে আছে । আর বেশীক্ষণ এ-রকম থাকলে সে ঠিক পাগল হয়ে যাবে ।