চাদের পাহাড় Woo. নদীর তীর পর্য্যস্ত। এই তিনশো মাইলের খানিকট পড়েছে বিখ্যাত কালাহারি মরুভূমির মধ্যে, প্রায় ১৭৫ মাইল, অতি ভীষণ, জনমানবহীন, জলহীন, পথহীন মরুভূমি। মিলিটারি ম্যাপ থেকে আলভারেজ নোট করেছে যে, এই অঞ্চলের উত্তরপূর্ব কোণ লক্ষ্য করে একটি বিশেষ পথ ধরে না গেলে, মাঝামাঝি পার হতে যাওয়াব মানেই মৃত্যু। ম্যাপে এর নাম দিয়েছে ‘তৃষ্ণার দেশ' (Thirstland Trek ) । রোডেসিয়া পৌছুতে পারলে যাওয়া অনেকটা সহজ হয়ে উঠবে, কারণ সে-সব স্থানে মানুষ আছে। শঙ্কর এখানে অত্যন্ত সাহসের পরিচয় দিলে। পথের এই ভয়ানক অবস্থা জেনে-শুনেও সে দমে গেল না, হাত-পা-হারা হয়ে পড়ল না। এই পথে আলভারেজ এক গিয়ে সল্স্বেরি থেকে টোটা ও খাবার কিনে আনবে বলেছিল । বাষটি বছরের বৃদ্ধ যা পারবে বলে স্থির করেছিল, সে তা থেকে পিছিয়ে যাবে ? কিন্তু সাহস ও নিৰ্ভীকতা এক জিনিস, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ অন্য জিনিস। ম্যাপ দেখে গন্তব্যস্থানের দিক্ নির্ণয় করার ক্ষমতা শঙ্করের ছিল না । সে দেখলে ম্যাপের সে কিছুই বোবে না। মিলিটারি ম্যাপগুলোতে ছুটে মরুমধ্যস্থ কূপের অবস্থান-স্থানের ল্যাটচিউড লঙ্গিচিউড় দেওয়া আছে, 'ম্যাগ নেটিক্ নৰ্থ’ আর ট্র, নর্থ ঘটিত কি একট। গোলমেলে অঙ্ক কষে বার করতো আলভারেজ, শঙ্কর দেখেছে কিন্তু শিখে নেয় নি। সুতরাং অদৃষ্ঠের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় কি? অদৃষ্টির উপর নির্ভর করেই শঙ্কর এই দুস্তর মরুভূমিতে পাড়ি দিতে প্রস্তুত হল। ফলে, দুদিন যেতে না যেতেই শঙ্কর সম্পূর্ণ দিগভ্ৰাস্ত হয়ে পডল। ম্যাপ-দৃষ্টে যে কোনো অভিজ্ঞ লোক যে জলাশয় চোখ বুজে খুজে বার করতে পারতে—শঙ্কর তার তিন মাইল উত্তর দিয়ে চলে গেল, অথচ তখন তার জল ফুরিয়ে এসেছে, নতুন পানীয় জল সংগ্রহ করে না নিলে জীবন বিপদাপন্ন হবে। প্রথমতঃ শুধু প্রাস্তর আর পাহাড়, ক্যাক্টাস ও ইউফোবিয়ার বন, মাঝে মাঝে গ্রানাইটের কৃপ। তার পর কি ভীষণ কষ্টের সে পথ-চলা ! খাদ্য নেই, জল নেই, পথ ঠিক নেই, মানুষের মুখ দেখা নেই। দিনের পর দিন শুধু সুদূর, শূন্য-দিথলয় লক্ষ্য করে সে হতাশ পথ-যাত্রা—মাথার ওপর আগুনের মত সূর্য্য, পায়ের নীচে বালি পাথর যেন জলস্ত অঙ্গার, সূৰ্য্য উঠছে, অস্ত যাচ্ছে—নক্ষত্র উঠছে, চাদ উঠছে—আবার অস্ত যাচ্ছে। মরুভূমির গিরগিটি একঘেয়ে স্বরে ডাকছে, ঝি বি ডাকৃছে-সন্ধ্যায়, গভীর নিশীথে । . মাইল-লেখা পাথর নেই, কত মাইল অতিক্রম করা হল তার হিসেব নেই। খাদ্য দুএকটা পার্থী, কখনো বা মরুভূমির বুজার্ড শকুনি, যার মাংস জঠুর ও বিস্বাদ। এমন কি একদিন একটা পাহাড়ী বিষাক্ত কাকৃড়া বিছে, যার দংশনে মৃত্যু—তাও যেন পরম মুখাদ্য, মিললে মহা সৌভাগ্য। দুদিন ঘোর তৃষ্ণায় কষ্ট পাবার পরে পাহাড়ের ফাটলে একটা জলাশয় পাওয়া গেল। কিন্তু জলের চেহারা লাল, কতকগুলো কি পোকা ভাসছে জলে—ডাঙায় একটা কি জন্তু মরে পচে ঢোল হয়ে আছে। সেই জলই আকণ্ঠ পান করে শঙ্কর প্রাণ বাচালে ।
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৭৮
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।