চাদের পাহাড় १७ করতেই হবে খাদ্য ও জলের চেষ্টায়, ভাগ্যে পাহাডের এই স্থানটা যেন খানিকটা সমতলভূমির মত, তাই রক্ষা। এই সব অবস্থায়, এই মুম্বন্যবাসহীন পাহাড়ে বিপদ তো পদে পদেই। এক এ পাহাড় টপকাতে গেলে যে কোনো ইউরোপীয় পর্যটকেরও ঠিক এই রকম বিপদ ঘটতে পারতে । শঙ্কর আর পারে না। ওর হৃৎপিণ্ডে কি একটা রোগ হয়েছে, একটু হাটলেই ধড়াস ধড়াস্ করে হৃৎপিণ্ডটা পাজরায় ধাক্কা মারে। অমাহুষিক পথশ্রমে, দুর্ভাবনায়, অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে, কখনও বা অনাহারের কষ্ট্রে, ওর শরীরে কিছু নেই। চারদিনের দিন সন্ধ্যাবেলা অবসন্ন দেহে সে একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিলে । খাদ্য নেই কাল থেকে। রাইফেল সঙ্গে আছে, কিন্তু একটা বহু জন্তুর দেখা নেই। দুপুরে একট। হরিণকে চরতে দেখে ভরসা হয়েছিল, কিন্তু রাইফেলটা তখন ছিল পঞ্চাশ গজ তফাতে একট। গাছে ঠেস দেওয়া, আনতে গিয়ে হরিণটা পালিয়ে গেল। জল খুব সামান্যই আছে, চামড়ার বোতলে। এ অবস্থায় নেমে সে ঝরণা থেকে জল আনবেই বা কি করে ? হাটুটা আরও ফুলেছে। বেদন এত বেশী যে, একটু চলাফেরা করলেই মাথার শির পর্য্যন্ত ছিড়ে পডে যন্ত্রণায় । পরিষ্কার আকাশতলে আদ্রতাশূন্য বায়ুমণ্ডলের গুণে অনেকদূর পর্য্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দিকৃচক্রবালে মেঘলা করে ধিরেছে নীল পর্বতমালা দূরে দূরে। দক্ষিণ-পশ্চিমে দিগন্ত-বিস্তীর্ণ কালাহারি। দক্ষিণে ওয়াহকুহকু পৰ্ব্বত, তারও অনেক পেছনে মেঘের মত দৃশ্যমান পল ক্রুগার পৰ্ব্বতমালা—সলবেরির দিকে কিছু দেখা যায় না, চিমানিমানি পৰ্ব্বতের এক উচ্চতর শৃঙ্গ সেদিকে দৃষ্টি আট কেছে। আজ দুপুর থেকে ওর মাথার ওপর শকুনির দল উড়েছে। এতদিন এত বিপদেও শঙ্করের যা হয় নি, আজ শকুনির দল মাথার ওপর উড়তে দেখে শঙ্করের সত্যই ভয় হয়েছে। ওরা তাহলে কি বুঝেছে যে শিকার জোটবার বেশী দেরি নেই ? সন্ধ্যার কিছু পরে কি একটা শব্দ শুনে চেয়ে দেখলে, পাশের শিলাখণ্ডের আড়ালে একটা ধূসর রঙের নেকড়ে বাঘ—নেকড়ের লম্বাছ চালে কান দুটো খাড়া হয়ে আছে, সাদা সাদা দাতের ওপর দিয়ে রাঙা জিবটা অনেকখানি বার হয়ে লকৃ লকৃ করছে। চোখে চোখ পড়তেই সেটা চট করে পাথরের আড়াল থেকে সরে দূরে পালালো । নেকড়ে বাঘটাও তাহলে কি বুঝেছে ? পশুরা নাকি আগে থেকে অনেক কথা জানতে পারে। হাড়ভাঙা শীত পড়লো রাত্রে। ও কিছু কাঠকুটো কুড়িয়ে আগুন জাললে। অগ্নিকুণ্ডের আলো যতটুকু পড়েছে তার বাইরে ঘন অন্ধকার। কি একটা জন্তু এসে অগ্নিকুণ্ড থেকে কিছু দূরে অন্ধকারে দেহ মিশিয়ে চুপ করে বসলো । কোয়োট, বন্যকুকুর জাতীয় জন্তু। ক্রমে আর একটা, আর দুটো, আর তিনটে । রাত বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে দশ-পনেরোটা এসে জমা হল। অন্ধকারে তার চারিধার ঘিরে
পাতা:বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড).djvu/৮৬
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।