পাতা:বিভূতি রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড).djvu/২৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Xe বিভূতি-রচনাবলী গোষ্ঠবাৰু চলিয়া গেলে একবার ঘরের জানালার কাছে আসিয়া দাড়াইলাম। দূরে জঙ্গলের মাথার চাদ উঠতেছে—আর সেই উদীয়মান চন্দ্রের পটভূমিকায় আঁকাবঁকা একটা বনঝাউয়ের ডাল, ঠিক যেন জাপানী চিত্রকর হকুসাই-অঙ্কিত একখানি ছবি। চাকুরী করিবার আর জায়গা খুজিয়া পাই নাই ! এ-সব বিপজ্জনক স্থান, আগে জানিলে কখনই অবিনাশকে কথা দিতাম না । দুর্ভাবনা সত্ত্বেও উদীয়মান চন্দ্রের সৌন্দৰ্য্য আমাকে বড় মুগ্ধ করিল। 8 কাছারির অনতিদূরে একটা ছোট পাথরের টিল, তার উপর প্রাচীন ও স্ববৃহৎ একটা বটগাছ। এই বটগাছের নাম গ্র্যান্ট সাহেবের বটগাছ। কেন এই নাম হইল, তখন অনুসন্ধান করিয়াও কিছু জানিতে পারি নাই। একদিন নিস্তব্ধ অপরাহ্লে বেড়াইতে বেড়াইতে পশ্চিম দিগন্তে স্বৰ্য্যাস্তের শোভা দেখিতে টিলার উপরে উঠিলাম। টিলার উপরকার বটতলায় আসন্ন সন্ধ্যার ঘন ছায়ায় দাড়াইয়া দাড়াইয়। কত দূর পর্য্যন্ত এক চমকে দেখিতে পাইলাম—কলুটোলার মেস, কপালীটোলাব সেই ব্রিজের আড্ডাটি, গোলদীঘিতে আমার প্রিয় বেঞ্চখানা—প্রতিদিন এমন সময়ে যাহাতে গিয়া বসিয়া কলেজ স্ট্রীটের বিরামহীন জনস্রোত ও বাস মোটরের ভিড় দেখিতাম। হঠাৎ যেন কতদূরে পড়িয়া রহিয়াছে মনে হইল তাহারা । মন হু-হু করিয়া উঠিল—কোথায় আছি! কোথাকার জনহীন অরণ্যে-প্রান্তরে খড়ের চালায় বাস করিতেছি চাকুরীর খাতিরে ! মানুষ এখানে থাকে ? লোক নাই, জন নাই, সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ—একটা কথা কহিবার মানুষ পৰ্য্যন্ত নাই। এদেশের এই সব মুখ, বৰ্ব্বর মানুষ, এরা একটা ভাল কথা বললে বুঝিতে পারে না—এদেরই সাহচর্য্যে দিনের পর দিন কাটাইতে হইবে ? সেই দূরবিসপী দিগন্তব্যাপী জনহীন সন্ধ্যার মধ্যে দাড়াইয়া মন উদাস হইয় গেল, কেমন ভয়ও হইল। তখন সঙ্কল্প করিলাম, এ-মাসের আর সামান্ত দিনই বাকী, সামনের মাসটা কোনরূপে চোখ বুজিয়া কাটাইব, তার পর অবিনাশকে একখানা লম্বা পত্র লিথিয়া চাকুরীতে ইস্তফা দিয়া কলিকাতায় ফিরিয়া গিয়া সভ্য বন্ধুবান্ধবদের অভ্যর্থনা পাইয়া, সভ্য খাদ্য খাইয়া, সভ্য মুরের সঙ্গীত শুনিয়া, মানুষের ভিড়ের মধ্যে ঢুকিয়া, বহু মানবের আনন্দ-উল্লাসভর কণ্ঠস্বর শুনিয়া বাচিব। পূৰ্ব্বে কি জানিতাম মানুষের মধ্যে থাকিতে এত ভালবাসি ! মানুষকে এত ভালবালি ! তাহাদের প্রতি আমার যে কৰ্ত্তব্য হয়ত সব সময় তাহা করিয়া উঠিতে পারি না—কিন্তু ভালবাসি তাহদের নিশ্চয়ই। নতুবা এত কষ্ট পাইব কেন তাহদের ছাডিয়া আসিয়া ? প্রেসিডেন্সি কলেজের রেলিঙে বই বিক্রি করে সেই যে বৃদ্ধ মুসলমানটি, কতদিন তাহার দোকানে দাড়াইয়া পুরনো বই ও মাসিক পত্রিকার পাতা উন্টাইয়াছি—কেনা উচিত ছিল