পাতা:বিভূতি রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড).djvu/২৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বিপিনের সংসার ২৩৫ তেইশ বছর আগের কথা । এই যে বদ্ধ বিছানার সঙ্গে মিশিয়া শুইয়া আছে, মাথায় পাকা চুল, গায়ের রং হাজিয়া আধকালো, দাত পড়িয়া গালে টোল খাইয়া গিয়াছে, বিশেষত জরে ভূগিয়া বর্তমানে তাড়ক রক্ষসীর মত চেহারা হইয়া উঠিয়াছে ধাহার, এই যে সেই একদিনের হাহুলাস্যময়ী হন্দরী কামিনী, যাহার চটুল চাহনিতে দোর্শগুপ্ৰতাপ বিনোদ চাটুজে নায়েব মহাশয়ের মাথা ঘূরিয়া গিয়াছিল, ইহাকে দেখিয়া কে বলিবে সে কথা ? প্রথম যৌবনে দুইজনের দেখাশোনা হয়। কামিনী ছিল গোয়ালার মেয়ে—বলিবিধব, স্বন্দরী । বিনোদ চাটুজ্জেও ছিলেন লম্বা-চওড়া জোয়ান, বড় বড় চোখ, গলার স্বর গভীর ও ভারী-পুরুষের মত শক্ত-সমর্থ চেহারা । তা ছাড়া ছিল অসম্ভব দাপট। পয়ত্রিশ-চল্লিশ বৎসর আগের কথা, তখন নায়েববাবুই ছিলেন এ অঞ্চলের দারোগা, নায়েববাবুই ম্যাজিস্ট্রেট । কামিনী বিনোদ চাটুজ্জেকে ভালবাসিবে, এ বিচিত্র কথা কি ? সারাজীবন একসঙ্গে যাহার সহিত কাটাইয়া, নিজের উজ্জ্বল ধোঁবন যাহাকে দান করিয়া কামিনী নারীজন্মের সার্থকতাকে বুঝিয়াছিল, সেই বিনোদ চাটুজ্জের অভাবে তাহার জীবন শূন্ত হইয়া পড়িবে ইহাও বিচিত্র কথা নয় । হয়তো এইমাত্র জরঘোরে অজ্ঞান অচৈতন্য কামিনীর মন ঘুরিয়া ফিরিতেছিল তাহার প্রথম যৌবনের সেই পাখী-ডাক, ফুল-ফোট, আলো-মাখ। মাধবী রান্ত্রির প্রহরগুলি অমুসন্ধান করিয়া, আবার মনে মনে সেখানে বাস করিয়া, হারানো রাত্রির শিশিরসিক্ত স্মৃতির পুনরুদ্বোধন করিয়া। হয়তো মনে পড়িতেছিল প্রথম দিনের সেই ছবিটি । ষোড়শী বালিকা তাহাদের বাড়ীর সামনের বেগুন ক্ষেত হইতে ছোট্ট চুপড়ি করিয়া বেগুন তুলিয়া ফিরিতেছিল। পথে আসিতেছিল যুবক বিনোদ চাটুজে, ধোপাখালি কাছারির নায়েব, ধোপাখালি গ্রামের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। সবাই বলাবলি করিত, নায়েববাবুর কাছে গেলে সব জব হয়ে যাবে এখন ! নায়েব এসেছে যা জবর ! কোন ট্য-ফো খাটবে না সেখানে। নায়েবের মত নায়েব । সে কৌতুহলের সহিত চাহিয়া দেখিল। বেশ মনে আছে, বেগুনের ক্ষেতের কঞ্চি-বাধা আগড়ের কাছে দাড়াইয়া । লম্ব, স্বপুরুষ, টকটকে ফর্সা, মাথায় ঢেউ-খেলানো কালো চুল—তবে বয়স খুব কম নয়। ত্রিশ-বত্রিশ হইবে, কিংবা তারও কিছু বেশি। নায়েববাবু যখন কাছাকাছি আসিয়া পড়িয়াছেন, তাহার তখন বড় লজ্জা হুইল। বঁ হাতে বেগুনের চুপড়িট, ডান হাতে কঞ্চির আগড়টা শক্ত করিয়া ধরিয়া রহিল। হঠাৎ বিনোদ চাটুজ্জে তাঁহারই দিকে মুখ ফিরাইয়া চাহিলেন। —বেগুন ওতে ? এ কাদের ক্ষেত ।