পাতা:বিভূতি রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড).djvu/১৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১২৮ বিভূতি-রচনাবলী সময় টিফিনের ছুটিতে কিংবা বেলা পড়িলে কতবার তিনি এই রকম ছাদে বেড়াইতেন, এই ছাদটিতে উঠিলেই সেই পুরানো দিন, তাহাদের সঙ্গে জড়িত কত মুখ মনে পড়ে ! একখানি মুখ মনে পড়ে—শ্বন্দর মুখখানি, ডাগর চোখে নিম্পাপ দৃষ্টি, আট-ন বছরের ছেলে, নাম ছিল স্বদেব। মুখের মধ্যে লেবেনচুষ পুরিয়া দিত, তখন নারাণবাবুর মাথার চুলে সবে পাক ধরিয়াছে, টিফিনের সময় রোজ পাক চুল আটগাছি দশগাছি তুলিয়া দিত। বলিত, আপনাকে ছেড়ে কোন স্কুলে যাব না তার। তারপর আর ভাল মনে হয় না—অগণিত ছাত্রসমূত্রে দূর হইতে দূরান্তরে তাহাঁদের অপশ্ৰিয়মাণ মুখ কখন যে হঠাৎ অদৃগু হইয়া গিয়াছিল, তার হিসাব মনের মধ্যে খুঁজিয়া মেলে না আয় । জীবনের পথ বহু পথিকের আসা-যাওয়ার পদচিহ্নে ভরা, কোথাও স্পষ্ট, কোথাও অস্পষ্ট । t ঘরে আসিয়া শুইবার ইচ্ছা হইল না, নারাণবাবু আবার ডাকিলেম, ও জগদীশ, কী করলে রান্নাবান্না ? জ্যোতিবিনোদ অন্নপিগুরুদ্ধ স্বরে বলিলেন, খেতে বসেচি দাদা। —আচ্ছা, থাও খাও— এই স্কুলবাড়ীর ছোট ঘরটিতে কত কাল বাস ! কত স্বপরিচিত পরিবেশ, কত দূর অতীতের স্মৃতিভর মাস, বৎসর, যুগ ! আশপাশের বাড়ীর গৃহস্থ জীবনের কত মুখ, আনন, সঙ্কট র্তাহার চোখের উপর ঘটিয়া গিয়াছে। মনে মনে তিনি এই অঞ্চলের পাড়াহুদ্ধ ছেলে মেয়ে, তরুণী কন্যা বধূদের বুড়ো দাছ, যদিও তাহাদের মধ্যে কেহই তাহাকে জানে না, চেনে না। আদর্শ শিক্ষক অনুকূলবাবুর "তিপূত এই বিদ্যালয়গৃহ, এ জায়গা ষে কত পবিত্ৰ—কী যে এখানে একদিন হইয়া গিয়াছে, তার খোজ রাখেন শুধু নারাণবাবু। আজি মনে এত আনন্দ কেন ? কী অপূর্ব আনন্দ, একটা তরুণ মনের আস্তরিক শ্রদ্ধা ও ভক্তি আজ তিনি আকর্ষণ করিতে পারিয়া ধন্য হইয়াছেন। অমুকুলবাবু বলিতেন, দেখ নারাণ, একটা বেলগাছে বছরে কত বেল হয় দেখেচ ? একটা বেলের মধ্যে কত বিচি থাকে, প্রত্যেক বিচিটি থেকে এক হাজার মহীরুহ জন্মাতে পারে r কিন্তু তা জন্মায় না। একটা বেলগাছের ষাট-সত্তর বৎসরব্যাপী জীবনে অত বিচি থেকে গাছ জন্মায় না—অন্তত দুটি বেলচার মানুষ হয়, বড় হয়, আবার বহু বেল ফল দেয়। বহু অপচয়ের হিসেব কষেই এই পুষ্টির ইঞ্জিনীয়ারীং দাড় করিয়ে রেখেছেন ভগবান। তার মধ্যেই অপচয়ের সার্থকতা। স্কুলের সব ছেলে কি মানুষ হয় ? একটা স্কুল থেকে ষাট বছরে দুটো-একটা মাছুষ বার হলেও স্থলের অস্তিত্ব সাধক। এই ভেবেই আনন্দ পাই নারাণ। প্রত্যেক শিক্ষক, যিনি শিক্ষক নামের যোগ্য—এই ভেবেই তার আনন্দ ও উৎসাহ । দেশের সেবার সব চেয়ে বড় অর্থ্য র্তারা যোগান-মানুষ। জ্যোতির্বিানো নারাণবাবুর সামনে বিড়ি খান না। আড়ালে দাড়াইয়া ধূমপান শেষ করিয়া,ছাদের এধারে আলিয়া বলিলেন, দাদা, এখনও খান নি ? রাত অনেক হয়েছে।