পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাজবৌ
১৩

তুই যা, আমি পরে যাব।

 তাহার কান্নাকাটির কাছে সে নিজের অসুখের কথা বলিতে পারিল না। বিশেষ, সকল রকম রোগের সেবা করিয়া এ বিষয়ে তাহার এত অধিক দক্ষতা জন্মিয়াছিল যে, আশপাশের গ্রামের মধ্যে কাহারও শক্ত অসুখ-বিসুখে তাহাকে একবার না দেখাইয়া, তাহার মুখের আশ্বাসবাক্য না শুনিয়া রোগীর আত্মীয়স্বজনেরা কিছুতেই ভরসা পাইত না! নীলাম্বর এ কথা নিজেও জানিত। ডাক্তার কবিরাজের ঔষধের চেয়ে, দেশের অশিক্ষিত লোকের দল তাহার পায়ের ধুলা, তাহার হাতের জলপড়াকে যে অধিক শ্রদ্ধা করে, ইহা সে বুঝিত বলিয়াই কাহাকেও কোনদিন ফিরাইয়া দিতে পারিত না। মতি চাঁড়াল আর একবার কাঁদিয়া, আর একবার পায়ের ধূলার দাবী জানাইরা, চোখ মুছিতে মুছিতে চলিয়া গেল। নীলাম্বর উদ্বিগ্ন হইয়া ভাবিতে লাগিল। তাহার দেহ তখনও ঈষৎ দুর্বল ছিল বটে, কিন্তু সে কিছুই নয়। সে ভাবিতে লাগিল, বাড়ির বাহির হইবে কি করিয়া। সে বিরাজকে অত্যন্ত ভয় করিত, তাহার কাছে এ কথা সে মুখে আনিবে কি করিয়া?

 ঠিক এই সময়ে ভিতরের উঠান হইতে হরিমতির সুতীক্ষ্ণ কণ্ঠে ডাক আসিল,—দাদা, বৌদি ঘরে এসে শুতে বলচে।

 নীলাম্বর জবাব দিল না।

 মিনিট-খানেক পরেই হরিমতি নিজে আসিয়া হাজির হইল। বলিল, শুনতে পাওনি দাদা?

 নীলাম্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিল, না।

 হরিমতি কহিল, সেই চারটি খেয়ে বসে আছ,—বৌদি বলচে আর বসে থাকতে হবে না, একটু শোও গে।

 নীলাম্বর আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, সে কি করচে রে পুঁটি?

 হরিমতি কহিল, এইবার ভাত খেতে বসেচে।

 নীলাম্বর আদর করিয়া বলিল, লক্ষ্মীদিদি আমার, একটি কাজ করবি?

 পুঁটি মাথা নাড়িয়া বলিল, করব।

 নীলাম্বর কণ্ঠস্বর আরও কোমল করিয়া কহিল, আস্তে আস্তে আমার চাদর আর ছাতিটা নিয়ে আয় দেখি!

 চাদর আর ছাতি?

 নীলাম্বর কহিল, হুঁ।

 হরিমতি চোখ কপালে তুলিয়া বলিল, বাপ রে। বৌদি ঠিক এই দিকে মুখ করে খেতে বসেচে যে।

 নীলাম্বর শেষ চেষ্টা করিয়া বলিল, পারবি নে আনতে?

 হরিমতি অধর প্রসারিত করিরা দুই-তিনবার মাথা নাড়িয়া বলিল, না দাদা দেখে