পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/২৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪
বিরাজবৌ

হাঁ করিয়া সেই দিকে চাহিয়া ছিল। হঠাৎ বলিল, সত্যি কথা মা, তোমার মত রূপ আমি মানুষের কখন দেখিনি—এত রূপ রাজা-রাজড়ার ঘরেও নেই।

 বিরাজ তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়া ঈষৎ বিরক্তভাবে বলিল, তুই রাজারাজড়ার ঘরের খবর রাখিস?

 সুন্দরীর বয়স পয়ত্রিশ-ছত্রিশ। রূপসী বলিয়া তাহারও এক সময় খ্যাতি ছিল, সে খ্যাতি আজিও সম্পূর্ণ লুপ্ত হয় নাই।

 সে বলিত, কবে তাহার বিবাহ হইয়াছিল, কবে বিধবা হইয়াছিল, কিছুই মনে পড়ে না, কিন্তু সধবার সৌভাগ্য হইতে একেবারে বঞ্চিত হয় নাই। তাহাদের গ্রাম কৃষ্ণপুরে এ সুখ্যাতিও তাহার ছিল। এখন হাসিয়া বলিল, রাজারাজড়ার ঘরের খবর রাখি বৈ কি মা! না হলে সেদিন তাকে ঝাঁটাপেটা কত্তুম।

 এবার বিরাজ রীতিমত রাগ করিল, বলিল, তুই যখন তখন ঐ কথাই বলিস কেন সুন্দরী? তাদের যা খুশী বলেছে, তাতে তুই বা ঝাঁটাপেটা করবি কেন? আর আমাকেই বা না’হক সোনাবি কেন? উনি রাগী মানুষ, শুনলে কি বলবেন বল ত?

 সুন্দরী অপ্রতিভ হইয়া বলিল, বাবু শুনবেন কেন মা? এও কি একটা কথার মত কথা!

 কথার মত কথা নয়, সে কথা কি তুই আমাকে বুঝিয়ে বলবি? তা ছাড়া যা হয়ে বয়ে চুকে শেষ হয়ে গেছে, সে কথা তোলবার দরকারই বা কি?

 সম্পূরী খপ করিয়া বলিল, কোথায় চুকেবুকে শেষ হয়েচে মা? কালও যে আমাকে ডাকিয়ে নিয়ে গিয়ে—

 বিরাজ রাগিয়া উঠিল। বলিল, তুই গেলি কেন? তুই আমার কাছে চাকরি করবি, আর যে ডাকবে তার কাছে ছুটে যাবি? তুই নিজে না বললি সেদিন তাঁরা সব কলকাতায় চলে গেছেন?

 সুন্দরী বলিল, সত্যি কথাই বলেছিলুম মা। মাস-দুই তারা চলে গিয়েছিলেন, আবার দেখচি সব এসেচেন। আর যাবার কথা যদি বললে মা, পিয়াদা ডাকতে এলে, না বলি কি করে? তাঁরা এ মুল্লুকের জমিদার, আমরা দুঃখী প্রজা—হুকুম অমান্যি করি কি ভরসায়?

 বিরাজ ক্ষণকাল চাহিয়া থাকিয়া কহিল, তাঁরা এ মুল্লুকের জমিদার নাকি?

 সুন্দরী সহাস্যে বলিল, হাঁ মা, এ মহালটা তাঁরাই কিনেচেন—বাবু তাঁবু খাটিয়ে আছেন—তা সত্যি মা, রাজপুত্তুর ত রাজপুত্তুর। কিবা মুখ চোখের—

 বিরাজ সহসা থামাইয়া দিয়া বলিল, থাম্ থাম্ চুপ কর্,। ও-সব কথা তোকে জিজ্ঞেস করিনি—কি তোকে বললে, তাই বল।

 সুন্দরী এবার মনে মনে বিরক্ত হইল। কিন্তু সে ভাব গোপন করিয়া ক্ষুব্ধস্বরে বলিল, কি কথা আর হবে মা, কেবল তোমারই কথা।