আমি কোথায় থাকি জান?
সুন্দরী কহিল, জানি।
রাজেন্দ্র বলিল, আজ একবার ওখানে আসতে পার?
সুন্দরী সলজ্জহাস্যে মুখ নীচু করিয়া আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করিল, কেন বাবু?
দরকার আছে, একবার যেও, বলিয়া রাজেন্দ্র বন্দুক কাঁধে তুলিয়া লইয়া চলিয়া গেল।
ইহার পর অনেকবার সুন্দরী গোপনে ও নিভৃতে ওপারের জমিদারী কাছারিতে গিয়াছে, অনেক কথা বিরাজের সমক্ষে উত্থাপন করিতে সাহস করে নাই। সুন্দরী নির্বোধ ছিল না; সে বিরাজবৌকে চিনিত। বাহির হইতে এই বধূটিকে যতই মধুর এবং কোমল দেখাক না কেন, ভিতরের প্রকৃতি যে তাহার উগ্র এবং পাথরের মত কঠিন ছিল, সুন্দরী তাহা ঠিক জানিত। বিরাজের দেহে আরও একটা বস্তু ছিল, সে তাহার অপরিমেয় সাহস। তা সে মানুষ বলেই হোক, আর সাপখোপ, ভূতপ্রেতই হোক—ভয় কাহাকে বলে ইহা সে একেবারেই জানিত না। সুন্দরী কতকটা সে কারণেও এতদিন তাহার মুখ খুলিতে পারে নাই।
বিরাজ উনুনের কাষ্ঠটা ঠেলিয়া দিয়া ফিরিয়া চাহিয়া বলিল, আচ্ছা সুন্দরী, তুই ত অনেকবার সেখানে গিয়েছিস এসেছিস, অনেক কথাও করেচিস, কিন্তু আমাকে ত একটি কথাও বলিস নি?
সুন্দরী প্রথমটা কিছু হতবুদ্ধি হইয়া গেল, কিন্তু পরক্ষণেই সামলাইয়া লইয়া কহিল, কে তোমাকে বললে মা, আমি অনেক কথা কয়ে এসেচি?
বিরাজ বলিল, কেউ বলেনি, আমি নিজেই জানি। আমার কপালের পেছনে আরও দুটো চোখ-কান আছে। বলি, কাল ক’টাকা বকশিশ নিয়ে এলি? দশ টাকা?
সুন্দরী বিস্ময়ে অবাক হইয়া গেল। তাহার মখের উপরে একটা পাণ্ডুর ছায়া পড়িল, উনুনের অস্পষ্ট আলোকেও বিরাজ তাহা দেখিল এবং সে যে কথা খুঁজিয়া পাইতেছিল না তাহাও বুঝিল।
ঈষৎ হাসিয়া বলিল, সুন্দরী, তোর বুকের পাটা এত বড় হবে না যে, তুই আমার কাছে মুখে খুলবি: কিন্তু, কেন মিছে আনাগোনা করে, টাকা খেয়ে শেষে বড়লোকের কোপে পড়বি? কাল থেকে এ বাড়িতে আর ঢুকিস নে। তোর হাতের জল পায়ে ঢালতেও আমার ঘেন্না করে। এতদিন তোর সব কথা জানতুম না, দুদিন আগে তা শুনেচি। কিন্তু যা, আঁচলে যে দশ টাকার নোট বাঁধা আছে, ফিরিয়ে দি গে, দিয়ে দুঃখী মানুষ দুঃখী-ধান্দা করে খে গে। নিজে বয়সকালে যা করেচিস, সে ত আর ফিরবে না, কিন্তু আর পাঁচজনের সর্বনাশ করতে যাসনে।
সুন্দরী কি একটা বলিতে চাহিল, কিন্তু তাহার জিভ মুখের মধ্যে আড়ষ্ট হইয়া