সুন্দরী বসিতে আসন দিল, তামাক সাজি দিল। নীলাম্বর আসন গ্রহণ করিয়া তাহার জীর্ণ মলিন উত্তরীয়ের ভিতর হইতে সেই কাপড়খানি বাহির করিয়া বলিল, তুই ত তাকে মানুষ করেচিস সন্দরী, যা একবার দেখে আয়। আর সে বলিতে পারিল না, মুখ ফিরাইয়া চাদরে চোখ মুছিল।
সুন্দরী ইহাদের কষ্টের কথা জানিত। গ্রামের সকলেই জানিত। কহিল, সে কেমন আছে বড়বাবু?
নিলাম্বর ঘাড় নাড়িয়া বলিল, জানিনে।
সুন্দরীর বুদ্ধি-বিবেচনা ছিল, সে আর প্রশ্ন করিল না। পরদিন সকালেই যাইবে জানাইতে নীলাম্বর কিছু পাথেয় দিতে গেল, সুন্দরী তাহা গ্রহণ করিল না; কহিল, বড়বাবু, কাপড় কিনে ফেলেচ, না হলে এও আমি নিয়ে যেতাম না—তোমার মত আমিও যে তাকে মানুষ করেচি।
নীলাম্বরের চোখ দিয়া আবার জল গড়াইয়া পড়িল, সে মুখ ফিরাইয়া ক্রমাগত চোখ মুছিতে লাগিল। এমন একটা সমবেদনার কথা সে কাহারও কাছে পায় নাই। সবাই কহে, সে ভুল করিয়াছে অন্যায় করিয়াছে, পুঁটি হইতেই তাহার সর্বনাশ হইয়াছে। উঠিবার উদ্যোগ করিয়া সে সুন্দরীকে বিশেষ করিয়া সাবধান করিয়া দিল যেন এইসব দুঃখ-কষ্টের কথা পুঁটি কোনমতে না জানিতে পারে।
নীলাম্বর চলিয়া গেল, সুন্দরীও এইবার একফোঁটা চোখের জল আঁচলে মুছিল। এই লোকটিকে মনে মনে সবাই ভালবাসিত, সবাই ভক্তি করিত।
সেদিন বিজয়ার অপরাহ্ন, বিরাজ ঘরে ঢুকিয়া দোর দিল। সন্ধ্যা না হইতেই কেহ খুড়ো বলিয়া বাড়ি ঢুকিল, কেহ নীলুদা বলিয়া বাহির হইতে চীৎকার করিল।
নীলাম্বর শুষ্কমুখে চণ্ডীমণ্ডপ হইতে বাহির হইয়া সুমুখে আসিয়া দাঁড়াইল। যথারীতি প্রণাম-কোলাকুলির পর তাহারা বৌঠানকে প্রণাম করিবার জন্য ভিতরের দিকে চলিল।
নীলাম্বরও সঙ্গে সঙ্গে আসিয়া দেখিল, বিরাজ রান্নাঘরেও নাই, শোবার ঘরেরও দ্বার রুদ্ধ। সে করাঘাত করিয়া ডাকিল, ছেলেরা তোমাকে প্রণাম করতে এসেচে বিরাজ।
বিরাজ ভিতর হইতে বলিল, আমার জ্বর হয়েছে—উঠতে পারব না।
তাহারা চলিয়া যাইবার খানিক পরেই আবার দ্বারে ঘা পড়িল। বিরাজ জবাব দিল না। দ্বারের বাহিরে মৃদুকণ্ঠে ডাক আসিল, দিদি, আমি মোহিনী—একবারটি দোর খোল।
তথাপি বিরাজ কথা কহিল না।