পাতা:বিরাজ বৌ - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বিরাজবৌ

 নীলাম্বর বলিল, কেন যাবে না; তুমি ‘কানী’ বলেচ, সেটা তোমার মিছে কথা। কিন্তু গাল টিপে দিলে কেন?

 বিরাজ কহিল, অত বড় মেয়ে, ঘুম থেকে উঠে চোখেমুখে জল দেওয়া নেই, কাপড় ছাড়া নেই, গোয়ালে ঢুকে বাছুর খুলে দিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখচে। আজ এক ফোঁটা দুধ পাওয়া গেল না। ওকে মারা উচিত।

 নীলাম্বর বলিল, না। ঝিকে গয়লা-বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু তুমি দিদি, হঠাৎ বাছুর খুলে দিতে গেলে কেন? ও কাজটা ত তোমার নয়।

 হরিমতি দাদার পিছনে দাঁড়াইয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমি মনে করেচি দুধ দোয়া হয়ে গেছে।

 আর কোন দিন মনে ক’রো। বলিয়া বিরাহ রান্নাঘরে ঢুকিতে যাইতেছিল, নীলাম্বর হাসিয়া বলিল, তুমিও একদিন ওর বয়সে মায়ের পাখি উড়িয়ে দিয়েছিলে। খাঁচার দোর খুলে দিয়ে মনে করেছিলে, খাঁচার পাখি উড়তে পারে না। মনে পড়ে?

 বিরাজ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া হাসিমুখে বলিল, পড়ে; কিন্তু ও বয়সে নয়—আরও ছোট ছিলাম। বলিয়া কাজে চলিয়া গেল।

 হরিমতি বলিল, চল না দাদা বাগানে গিয়ে দেখি, আম পাকল কি না।

 তাই চল দিদি।

 যদু চাকর ভিতরে ঢুকিয়া বলিল, নারায়ণ ঠাকুরদা বসে আছেন।

 নীলাম্বর একটু অপ্রতিভ হইয়া মৃদুস্বরে বলিল, এর মধ্যেই এসে বসে আছেন?

 রান্নাঘরের ভিতর হইতে বিরাজ এ কথা শুনিতে পাইয়া দ্রুতপদে বাহিরে আসিয়া চেঁচাইয়া বলিল, যেতে বলে দে খুড়োকে। স্বামীর প্রতি চাহিয়া বলিল, সকালবেলাতেই যদি ও-সব খাবে ত আমি মাথা খুঁড়ে মরব। কিসব হচ্ছে আজকাল।

 নীলাম্বর জবাব দিল না, নিঃশব্দে ভগিনীর হাত ধরিয়া খিড়কির দ্বার দিয়া বাগানে চলিয়া গেল।

 এই বাগানটির এক প্রান্ত দিয়া শীর্ণকায়া সরস্বতী নদীর মৃদু স্রোতটুকু গঙ্গাযাত্রীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মত বহিয়া যাইতেছিল। বঙ্গি শৈবালে পরিপূর্ণ; শুধু মাঝে মাঝে গ্রামবাসীরা জল আহরণের জন্য কূপ খনন করিয়া রাখিয়া গিয়াছে। তাহারই আশেপাশে শৈবালমুক্ত অগভীর তলদেশে বিভক্ত শুক্তিগুলি স্বচ্ছ জলের ভিতর দিয়া অসংখ্য মাণিক্যের মত সূর্যালোকে জ্বলিয়া জ্বলিয়া উঠিতেছিল। তীরে একখণ্ড কালো পাথর সমীপস্থ সমাধিস্তূপের প্রাচীরগাত্র হইতে কোন এক অতীত দিনের বর্ষার খরস্রোতে স্খলিত হইয়া আসিয়া পড়িয়াছিল। এ বাড়ির বধূরা প্রতিসন্ধ্যায় তাহারই একাংশ মৃতাত্মার উদ্দেশে দীপ জ্বালিয়া দিয়া যাইত। সেই