শ্বর হইতে বেহারের মধ্যবর্ত্তী পাটনা পর্য্যন্ত স্থানে ইষ্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানীর যতগুলি কুঠি ছিল, তাহা উক্ত কোম্পানীর দপ্তরে ‘Bengal Establishment’ বলিয়া বর্ণিত দেখা যায়। ফ্রান্সিস্ ফার্ণাণ্ডেজ্ চট্টগ্রামের সুদূর পূর্ব্ব হইতে উড়িষ্যার অন্তর্গত পামিরা পয়েণ্ট (Palmyra Point) পর্য্যন্ত বিস্তৃত উপকূল এবং গঙ্গাপ্রবাহিত ভূমিভাগ লইয়া বাঙ্গালা সীমা নির্দ্দেশ করিয়াছেন। পার্কাসের (Purchas) মতে, এই উপকূলভাগ প্রায় ৬০০ মাইল।
বাঙ্গালার ছোট লাটের শাসনাধীন বাঙ্গালা, বিহার ও উড়িষ্যা প্রদেশ নদীমালা ও তাহাদের অববাহিকা এবং উপত্যকা ভূমিতে পূর্ণ। ছোট নাগপুর বিভাগ পর্ব্বতমণ্ডিত, উহা মধ্যপ্রদেশের অধিত্যকা হইতে বাঙ্গালাকে পৃথক্ রাথিয়াছে। উড়িষ্যাবিভাগ মহানদী ও অন্যান্য কতকগুলি নদীর বদ্বীপে সমাচ্ছন্ন। ঐ নদীগুলি প্রধানতঃ উত্তরপশ্চিমে করদ পার্ব্বত্য রাজ্য (Tributary Hill State) হইতে দক্ষিণপশ্চিমে বঙ্গোপসাগর পর্য্যন্ত আসিয়াছে। উড়িষ্যার সমুদ্রোপকূল হইতে ইংরাজাধিকৃত ব্রহ্মের সাগর-সীমা এবং উত্তরে হিমালয় পর্য্যন্ত বিস্তৃত দেশভাগ প্রকৃত বাঙ্গালা প্রদেশ পদবাচ্য। ইহার দক্ষিণাংশ গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের বদ্বীপভূমি বলিয়া গৃহীত এবং উত্তরাংশ উক্ত নদীদ্বয়ের ও তাহার শাখা প্রশাখার প্রবাহ-ক্ষেত্র বা উপত্যকা ভিন্ন আর কিছুই নহে। বেহার বিভাগ খাস-বাঙ্গালার উত্তরপশ্চিমে অবস্থিত। উহা গঙ্গার উচ্চ উপত্যকা লইয়া গঠিত। যুক্তপ্রদেশ ও বেহারের সীমায় গঙ্গানদী দক্ষিণপূর্ব্বাভিমুখে বক্রতা প্রাপ্ত হইয়াছে। বেহার ও উড়িষ্যার মধ্যবর্ত্তী এবং অপেক্ষাকৃত পশ্চিম পার্ব্বত্য ভূখণ্ডই ছোটনাগপুর বলিয়া পরিগণিত।
পূর্ব্বাপর আলোচনা করিলে বেশ বুঝা যায় যে, বাঙ্গালার সীমা কোন সময়েই একটা স্থির ছিল না। পার্শ্ববর্ত্তী রাজন্যবর্গের আক্রমণে সময় সময় ইহার অঙ্গচ্যুতি ঘটিয়াছিল। বঙ্গের শেষ মুসলমান নবাব সিরাজউদ্দৌলার হস্ত হইতে বঙ্গসিংহাসন চ্যুত এবং বঙ্গের দেওয়ানী দিল্লীশ্বর কর্ত্তৃক ইংরাজকরে সমৰ্পিত হইলেও আরাকান ও ব্রহ্মবাসিগণ বাঙ্গালার সীমান্তপ্রদেশ আলোড়িত করিয়াছিল। সিপাহীবিদ্রোহের পর ইষ্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানির শাসন অপসৃত হইলে, মহারাণী ভিক্টোরিয়া স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেন। তখন সুপ্রীমকোর্ট ও সদর দেওয়ানী আদালত উঠাইয়া নিজামত লইয়া হাইকোর্ট স্থাপিত হয়। ইংরাজগবর্মেণ্ট বিশেষ দৃঢ়তার সহিত বাঙ্গালার শাসন-ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন। ১৮৭৭ খৃষ্টাব্দে মহারাণী “ভারতসম্রাজ্ঞী” পদে অভিষিক্ত হইলে, ভারতে ইংরাজ প্রভাব অক্ষুণ্ণ হইয়া উঠিল। ভোটানযুদ্ধ ও মণিপুরযুদ্ধাবসানে বাঙ্গালার সীমা পরিবর্দ্ধিত হইল। ইংরাজগবর্মেণ্ট বাঙ্গালাকে প্রেসিডেন্সীভুক্ত করিয়া লইলেন।ইংরাজাধিকৃত এই বাঙ্গালা রাজ্য ক্রমে একটী প্রেসিডেন্সীরূপে ৰিভক্ত হইল। শুদ্ধ গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রপ্রবাহিত সমস্ত অববাহিকা প্রদেশ বলিয়া নহে, সিন্ধুনদের সমগ্র অববাহিকা প্রদেশ ও তাহার হিমালয় পৃষ্ঠস্থ শাখা প্রশাখাব্যাপ্তস্থান লইয়া প্রকৃতপক্ষে এই বিভাগ গঠিত। মোট কথায়, বিন্ধ্যশৈলমালার উত্তর দিগ্বর্ত্তী প্রায় সমগ্র আর্য্যাবর্ত্ত ভূমি বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সীর অন্তর্ভুক্ত। বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সীর এই বিভাগ সম্বন্ধে অধুনা কেবল ঐতিহাসিকতাই বিদ্যমান আছে, ফলে তদ্দ্বারা শাসনসম্পর্কীয় কোন কার্য্যই আর নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হয় না। ইংরাজরাজের ভারতীয় সেনাদলের সামরিক বিভাগে Commanders-in-chief for Bengal, Madras ও Bombay নামে আজিও সেই বিভাগের সাক্ষ্য রহিয়াছে। যে পাঁচটী সুবৃহৎ প্রদেশ মাত্র লইয়া ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী’ গঠিত হইয়াছিল, সেই পাঁচটী প্রদেশেই এখন নির্দ্দিষ্ট বিভিন্ন শাসনকর্ত্তার অধীন; কিন্তু সকলের উপর ভারতরাজপ্রতিনিধি কর্ত্তৃত্ত্ব করিয়া থাকেন। বোম্বাই ও মান্দ্রাজ প্রেসিডেন্সী স্বতন্ত্র গবর্ণরের দ্বারা শাসিত; কিন্তু বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীর অধীনস্থ যুক্তপ্রদেশ, পঞ্জাব, আজমীঢ় ও আসাম স্বতন্ত্র শাসনকর্ত্তার অধীন হইয়াছে। বস্তুতঃ ছোটলাটের অধীন সমগ্র বাঙ্গালাপ্রদেশ এখন প্রেসিডেন্সী পদবাচ্য হইয়া রহিয়াছে।
১৮৮১ খৃষ্টাব্দের ইম্পিরিয়াল সেন্সাস রিপোর্টের ২য় খণ্ডে বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সীর এইরূপ একটী বিভাগ তালিকা প্রদত্ত হইয়াছে,—
বাঙ্গালা প্রেসিডেন্সী এই ঐতিহাসিক বিভাগ সংঘটিত হইবার বহুপরে অর্থাৎ ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে মধ্যপ্রদেশে একটী স্বতন্ত্র শাসনবিভাগ গঠিত হইয়াছিল। কিন্তু যে বাঙ্গালা বঙ্গবাসীর জন্মভূমি, যাহা গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের উপত্যকা লইয়া প্রধানতঃ গঠিত, তাহাই ইংরাজরাজের রাজকীয় দপ্তরে নিম্ন বঙ্গ (Lower Bengal) নামে বর্ণিত হইয়াছে।
প্রাকৃতিক দৃশ্য।