গৌড়ের নিকট পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, অথবা আরও পূর্ব্বে, গঙ্গাসাগর সঙ্গম যখন রাজমহলের সান্নিধ্যে অবস্থিত ছিল, সেই সময়ে সমুদ্রের জল কখনই এই মাটিকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় নাই। যেহেতু অল্পকাল সমুদ্র সরিয়া গেলে, যে সকল চিহ্ন পশ্চাতে পড়িয়া থাকে এবং যে সকল জলজজীবের পঞ্জরাদি মৃত্তিকায় অস্থীভূত হইয়া যায়, এ ভূভাগের কোথাও তাহার চিহ্নমাত্র নাই।
দ্বিতীয় বিভাগ। পদ্মা বা বড়-গঙ্গার উত্তর-তীর হইতে হিমালয়ের পাদদেশস্থ তরাই ভূমি পর্য্যন্ত সমস্ত ভূভাগ ও হিমালয়ের ঢালু ভূমি। ইহা হিমালয়ের উচ্চ প্রদেশ হইতে পদ্মার উত্তর তট পর্য্যন্ত ক্রমাগত ঢালু হইয়া আসিয়াছে। এই ভূভাগের সর্ব্বত্রই জমির প্রকৃতি এক প্রকার—সর্ব্বত্রই হিমালয়ের গাত্রবিধৌত বালুকারাশি বিস্তৃত। তাহার উপর কিঞ্চিৎ পরিমাণে বালুকামিশ্রিত দো-আঁশ মাটি জন্মিয়া ঐ মৃত্তিকাকে চাস আবাদাদি কার্য্যের উপযোগী করিয়াছে। এই ঢালু বালুকাময় জমিতে, সর্ব্বত্রই হিমালয়ের গাত্র-ধৌত জলরাশি অন্তঃ-সলিলভাবে প্রবাহিত থাকায়, সমস্ত দেশের ভূমিই স্বল্পপরিমাণে জলসিক্ত ও আর্দ্র রহিয়াছে। ঐ মৃত্তিকায় বালীর আধিক্যবশতঃ এ সকল প্রদেশে কূপ খনন ব্যতীত, অন্য উপায় নাই। পুষ্করিণী খনন করিতে গেলেই, বালী ভাঙ্গিয়া গর্ত্ত বুজিয়া যায়। ফলতঃ অতি দীর্ঘায়তন দীর্ঘিকা খনন করা যাইতে পারে।
বড়ই আশ্চর্য্যের বিষয়, সমুদ্র হইতে এত দূরে ও হিমালয়পাদমূলে এত বালুকা কোথা হইতে আসিল? ভূতত্ত্ববিদ্গণ বলেন, পৃথিবীর ভূপঞ্জর নির্ম্মিত হওয়ার “ইওসিন্” যুগে, হিমালয়ের তটদেশ পর্য্যন্ত সমুদ্র-তরঙ্গ প্রবাহিত ছিল। কেবল তটভাগ বলিয়া নহে, তাহার বর্ত্তমান উচ্চতার প্রায় একতৃতীয়াংশ পর্য্যন্ত তখনও সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত। ইওসিনের পর মিওসিন্, প্লিওসিন্ এবং তাহার পরে ভূপঞ্জরের চতুর্থযুগের স্তরনির্ম্মাণ ক্রিয়া চলিতেছে। ইহার মধ্যে মিওসিন্ স্তরেই প্রথম মনুষ্যসৃষ্টির চিহ্ন প্রাপ্ত হওয়া যায়; তাহার মধ্যেও আবার নিম্ন মিওসিনে প্রাপ্ত চিহ্নগুলি অতি অস্পষ্ট ও সন্দেহজনক। উপর মিওসিন্ হইতেই কেবল মানবীয় অস্তিত্বের স্পষ্ট চিহ্ন প্রাপ্ত হওয়া যায় বলিয়া উহাকে মানবীয় যুগের আরম্ভকাল বলা যাইতে পারে। এইরূপ এক একটা স্তর গঠিত হইতে কত লক্ষ লক্ষ বর্ষ গত হইয়া যায়। সুতরাং তত কালের সমুদ্র-পরিত্যক্ত বালী আজিও প্রস্তরাবস্থায় পরিণত না হইয়া যে নিজাবস্থায় পতিত রহিয়াছে, ইহা কখনই সম্ভবপর বলিয়া বিবেচিত হয় না।
বর্ত্তমান বালুকারাশি হিমালয়ের গাত্রবিধৌত প্রস্তররেণুকা ভিন্ন আর কিছুই নহে। একে হিমালয়ের ঢালুপ্রদেশ তায় প্রস্তরতৃতীয় বিভাগ। ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব্বতট হইতে নওয়াখালি, চট্টগ্রাম প্রভৃতি প্রদেশ এবং পশ্চিমদিকে তমোলুকের নিকটবর্ত্তী স্থানসমূহ। নৈসর্গিক কারণ বিশেষে[১] সমুদ্র সরিয়া গেলে, যেরূপ প্রকৃতির ভূমিভাগ উঠিয়া থাকে, অবিকল সেই প্রকার প্রকৃতিবিশিষ্ট ভূমি লইয়াই এই সমস্ত স্থানের উৎপত্তি। সমূহ অন্তৰ্হিত হইবার সময় স্থানবিশেষে যে সকল বালির স্তূপ রাখিয়া গিয়াছে, (যাহাকে বালিয়াড়ী বলা হয়), তাহাই ঐ সকল নবোদিত স্থানের প্রাচীনত্বের হেতু। এই সকল স্তূপ কোথাও খণ্ড খণ্ড পর্ব্বতাকারে বিদ্যমান আছে, কোথাও বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনতি উচ্চ পাহাড়শ্রেণীতে পরিণত হইয়াছে, কিন্তু স্থলবিশেষে এখনও অবিকল বালিয়াড়ী আকারেই রহিয়া গিয়াছে। তমোলুকের নিকটস্থ বালিয়াড়ী সকল এখন অবিকল বালুকাস্তূপ মাত্র, কিন্তু চট্টগ্রামাদি অঞ্চলে, তাহা পর্ব্বতাকারে পরিণত। এই সকল পর্ব্বতের বহিরাবরণ ভেদ করিলে অভ্যন্তরে এখনও সেই বালুকাস্তূপের পরিচয় পাওয়া যায়, তবে কোথাও কোথাও কিয়ৎপরিমাণে বালুকাস্তর পাথরের স্তরে পরিণত হইতে আরম্ভ করিয়াছে। এই সকল পর্ব্বতের অভ্যন্তর ভাগের সর্ব্বত্রই সামুদ্রিক জলজ জীবের পঞ্জরে পরিব্যাপ্ত। চট্টগ্রাম প্রদেশের সীতাকুণ্ড তীর্থের নিকট যে পর্ব্বতমালা আছে, তাহ কিয়ৎপরিমাণে আগ্নেয় স্বভাববিশিষ্ট হইলেও তাহাদের উৎপত্তি এবং পরিণতি কতকাংশ উক্ত প্রকারের সামুদ্রিক বালিয়াড় হইতে ঘটিয়াছে স্বীকার করিতে হইবে। ব্রহ্মদেশের পূর্ব সীমায় দক্ষিণ হইতে উত্তরমুখে যে পর্ব্বতমালা প্রধাবিত হইয়া হিমালয়ে ——
- ↑ ইওসিন যুগে যে সাগর-জল হিমালয়তট পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, ত্রেতাযুগে লঙ্কাধ্বংসের পর, তাহা স্বাভাবিক নিয়মে হিমাচল পৃষ্ঠ ত্যাগ করিয়া ক্রমশঃ লঙ্কাস্থানে সরিয়া যায়। লঙ্কাদ্বীপের বিস্তৃত ভূখণ্ডও ঐ সময়ে প্রাকৃতিক নিয়মে জলপ্রবাহে স্থানান্তরিত হইয়া পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে জনপদ ও দ্বীপাবলী পুনর্গঠন করে। নদীকূলে এই সাক্ষ্য বলবৎ। অনুমান হয় তাহাতেই বা ক্রমে নিম্নবঙ্গের উৎপত্তি।