প্রাপ্ত হয়। পুনশ্চ ঐ ভরাট ভূখণ্ড যখন জল ছাড়াইয়া জাগিয়া উঠে নাই, অথচ জমাট বাঁধিয়া গিয়াছে, তখন সমুদ্রজলের স্রোত-বেগ আর তাহার গাত্র কাটিয়া বিক্ষিপ্ত বা বিধৌত করিতে পারে না। বরং তাহার মধ্যস্থিত নিম্ন ও নরম অংশ সকল কাটিয়া তথায় গভীর রেখাপাত করিয়া থাকে। জমী জল ছাড়াইয়া উঠিলে, এই সকল গভীর রেখাই, তখন বদ্বীপ মধ্যে অনেক বৃহৎ ও ক্ষুদ্র নদী এবং খালের আকার ধারণ করে। এই নবোদিত ভূমিভাগ উহাদের জলক্রিয়া দ্বারা পুনর্ব্বার ভাঙ্গিয়া গড়িয়া ও ক্রমাগত জোয়ারের প্রবলতায় প্লাবিত হইয়া, পলিমাটির দ্বারা পুনর্নির্ম্মিত হইলে, একরূপ চিরস্থায়িত্ব প্রাপ্ত হইতে পারে। তখন অপেক্ষাকৃত পূর্ণনির্ম্মিত মাটি হইতে নদীনালা বিরল হইয়া, অপূর্ণ নিম্নভাগে সরিয়া পড়ে এবং তথায় পুনরায় তথাবিধরূপে নির্ম্মাণের কার্য্য করিতে থাকে। পূর্ণনির্ম্মিত অংশে তখন যে কিছু নদী ও খাল থাকে, তাহা গণনায় ও আয়তনে সামান্য এবং তদ্দ্বারা ভাঙ্গা গড়ার কার্য্যও এত মৃদুভাবে পরিচালিত হয় যে, দেশমধ্যস্থ মৃত্তিকাও বিশেষ রূপান্তর প্রাপ্ত হয় না।
গাঙ্গেয় বদ্বীপ এইরূপেই গঠিত হইয়াছে এবং এখনও উহার দক্ষিণভাগের গঠন-ক্রিয়া উক্ত প্রকারে পূর্ণপ্রতাপে চলিতেছে। নিত্যই মনুষ্যের বাস ও ব্যবহার উপযোগী নূতন নূতন ভূমিখণ্ড সমুদ্রজল ছাড়াইয়া উঠিতেছে। উপরোক্ত ভূগঠনপ্রক্রিয়ার অভিনয়ে, এখনও সমুদ্রগর্ভে মৃত্তিকা-নির্ম্মিত এমন অসংখ্য চর দেখিতে পাওয়া যায়, যাহা জোয়ারের সময় জলে ডুবিয়া থাকে, কিন্তু ভাটার সময় জাগিয়া উঠে। ঐ সকল জমির স্রোতবেগে তখন তাহাদের উপর নদী ও খালের যে খাতরেখা পড়িতে দেখা যায়, তাহাই ভবিষ্যতে অতি সুন্দরভাবে জাগা জমির পৃষ্ঠে নদী ও খালের আকারে প্রকাশ হইতে থাকে। কালে এ সকল নদীনালাও বিস্তৃতায়তন হইয়া সময়ে শুষ্কগর্ভ হইয়া সরিয়া যাইবে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ সকল দেশভাগে সংলগ্ন হইয়া একাকার ধারণ করিবে, তাহা বলাই বাহুল্য।
গৌড়ের পূর্ব-দক্ষিণস্থ সমুদ্রভাগও এইরূপে ভরাটপ্রাপ্ত ভূমিখণ্ডের উদয়ে ক্রমশঃ দক্ষিণমুখে সরিয়া যায় এবং সম্ভবতঃ সেই উন্নত ভূখণ্ডে বর্তমান সুন্দরবনের ন্যায় অসংখ্য নদী বা খাল পড়িয়াছিল। সেই সকল নদী ও খালের মধ্যে গঙ্গার মূলপ্রবাহই সর্ব্বাপেক্ষা প্রবল বা জলধারা ছিল। সেই মূলপ্রবাহ আজিও দুর্জ্জয় পদ্মার আকারে তটভূমি বিচূর্ণ করিয়া প্রবাহিত হইতেছে।
ফলতঃ সমুদ্র সরিয়া যাওয়ায় যখন সমুদ্রগর্ভে প্রথম বদ্বীপ সমুত্থিত হয়, তখন গঙ্গার মূলপ্রবাহ ভাগীরথী খাত দিয়া প্রবাহিতখৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে লিখিত পেরিপ্লুসে দেখা যায় যে, বর্ত্তমান রঙ্গপুর প্রভৃতি অঞ্চল হইতে তেজপাত ও অপরাপর বাণিজ্যদ্রব্য গঙ্গা বক্ষে নৌকা বা জাহাজ যোগে গাঙ্গেয় বন্দর অর্থাৎ তমোলুক বা তাম্রলিপ্তিতে আনীত হইত। অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, গঙ্গার মূলপ্রবাহ ভাগীরথীর খাদে প্রবাহিত না থাকিলে কিরূপে ঐ সকল বাণিজ্যদ্রব্য উত্তরবঙ্গ হইতে গঙ্গার দ্বারা বাহিত হইয়া তমোলুকমুখে আসিতে পারে না। অথবা এমনও হইতে পারে যে, এখন যেমন মেঘনার মুখে বহুদূর প্রবিষ্ট সমুদ্র খাড়ীকেও মেঘনা বলিয়া থাকে; তখনও সেইরূপ গঙ্গার মুখে বহুদূর প্রবিষ্ট এবং তমোলুকের তটবাহী সমুদ্রগাড়ীকে গঙ্গা বলিয়া ডাকিত। পেরিপ্লুসে গাঙ্গেয় বন্দরে বাণিজ্য দ্রব্যাদির প্রসঙ্গে সেই অর্থেই গঙ্গার নির্ব্বিশেষত্ব সূচিত হইয়াছে। পেরিপ্লুস হইতে প্রাপ্ত ইহার আনুসঙ্গিক আরও এই দুইটী প্রমাণ হইতে এই শেষোক্ত অনুমানই ঠিক বলিয়া অবধারিত করা যায়;—গঙ্গার উপর বাণিজ্যদ্রব্য বহনার্থ যে সকল নৌকা ব্যবহৃত হইত, তাহারা সমুদ্রগামী পোত; নদীতে যে সকল নৌকা যাতায়াত করে, তাহারা সম্ভবতঃ তথায় বাইতে সাহস পাইত না বলিয়াই সামুদ্রিক পোত ব্যবহৃত হইত। এতদ্ভিন্ন গঙ্গার মুখে ঘন সন্নিবিষ্ট জনপদ ও বাণিজ্য বন্দরাদি সহ “খ্রুসে” নামক একটা প্রকাণ্ড দ্বীপ ছিল। সুতরাং গঙ্গা দক্ষিণভাগে নদীর পরিবর্ত্তে বহুবিস্তৃত সমুদ্রখাড়ী বিদ্যমান না থাকিলে পেরিপ্লুসের এ দুইটি উক্তির কোন সঙ্গতি থাকে না।
ভাগীরথীর পূর্ব্বকূলস্থ মাটি ক্রমে ক্রমে উচ্চ ও অপেক্ষাকৃত কঠিন হইয়া উঠিলে এবং বদ্বীপের অপরাংশেও বহুল পরিমাণে ভূমিখণ্ড সকল নির্ম্মিত ও জলরেখা ছাড়াইয়া মস্তকোত্তলন করিলে বিবিধ নৈসর্গিক কারণের প্রবলতায়, গঙ্গার মূলস্রোত ভাগীরথী খাদ পরিত্যাগ করিয়া, পদ্মা নাম গ্রহণ ও স্বতন্ত্র খাদ অবলম্বনপূর্ব্বক, ভাগীরথীর পূর্ব্বকূলের আরও উত্তরপূর্ব্বভাগে সরিয়া গিয়াছিল। এখনও পদ্মা ক্রমশঃ উত্তরদিকে সরিয়া যাইতেছে। গত শত বৎসরের মধ্যে পদ্মার গতি কতটা সরিয়া গিয়াছে, তাহা ভাবিলেও আশ্চর্য্য হইতে হয়। ফরিদপুর জেলার মাদারিপুর মহকুমার কাছে যে ছোট খালটি এখন পালঙের নিম্ন দিয়া যাইয়া কীর্ত্তিনাশায় গিয়া মিশিয়াছে, তথায় ৭০ǀ৮০ বৎসর পূর্ব্বে পদ্মার মূল খাত ছিল; কিন্তু এখন পদ্মা তাহার ১৬ǀ১৭ ক্রোশ উত্তরে। যে ক্ষুদ্র নদী কুমার নামে