ফরিদপুর জেলার সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত, অন্যূন ১২৫ বৎসর পূর্ব্বে, তাহার অনেকাংশেই পদ্মার প্রাচীন প্রবাহ ছিল। তথা হইতে পদ্মা এখন বহু দূরে সরিয়া গিয়াছে।
গাঙ্গেয় বদ্বীপের অবস্থা যখন এইরূপই ছিল, তখনকার দেশবিভাগ কিরূপ ছিল, তাহার সংক্ষেপ আলোচনা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হইবে না। চীন-পরিব্রাজক হিউএন্ সিয়াং কাজিনগড়ের পরেই পৌণ্ড্রবর্দ্ধন রাজ্য দেখিয়াছিলেন। বর্ত্তমান ইষ্ট ইণ্ডিয়া রেলওয়ের সাহেবগঞ্জ ষ্টেসনের নিকটবর্ত্তী স্থান কাজিনগড় বলিয়। অনুমিত হয়। তথায় পর্ব্বতোপরি তেলিয়াগড় নামক একটী প্রাচীন কেল্লা, অনেক সুরম্য ও সুন্দর গৃহাদির ভগ্নাবশেষ এবং অনেক ভগ্ন দেবদেবীর মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। যাহা হউক, এই কাজিনগড় ও কুশী নদীর পূর্ব্বতট হইতে আরম্ভ করিয়া ব্রহ্মপুত্র পর্য্যন্ত বিস্তৃত পূর্ণিয়া, মালদহ, দিনাজপুর, রঙ্গপুর, বগুড়া, কোচবেহার প্রভৃতি স্থান লইয়া প্রাচীন পৌণ্ড্রবর্দ্ধন রাজ্য। পৌণ্ড্রবর্দ্ধনের পূর্ব্বে এবং ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব্বদিকে প্রধাবিত সমস্ত ভূভাগ লইয়া প্রাচীন প্রাগ্জ্যোতিষ বা কামরূপ রাজ্য।
হিউএন্ সিয়াং লিখিয়াছেন যে, কামরূপ হইতে প্রায় ২৫০ মাইল দক্ষিণে সমতট রাজ্য। এই দূরত্ব নিরূপণে, বোধ হয়, সমতট রাজ্যের পরিবর্ত্তে তাহার রাজধানীর দূরত্ব নিরূপণই হিউএন্ সিয়াংএর অভিপ্রেত। বর্ত্তমান ঢাকা, পাবনা, প্রভৃতি জেলা বোধ হয় তৎকালে সমতট রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এবং পদ্মার বর্ত্তমান খাতের দক্ষিণেও কিছুদূর পর্য্যন্ত এই রাজ্য বিস্তৃত থাকে। পদ্মা ক্রমশঃ আরও উত্তরে অর্থাৎ তাহার বর্ত্তমান স্থানে সরিয়া যাওয়ার পর, এই দক্ষিণাংশ, ক্রমে গাঙ্গেয় বদ্বীপের অন্তর্গত হইয়া পড়িয়াছে। সেকালের সমতট রাজ্যের আয়তন পদ্মার প্রসরণশীল গতির দ্বারা অনেক রূপান্তর প্রাপ্ত হইয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। কেবল সেকালের সমতট কেন?—এ কালের বিক্রমপুরেরও বহু রূপান্তর ঘটিয়াছে। পূর্ব্বে উত্তর বিক্রমপুর ও দক্ষিণ বিক্রমপুর একই সংলগ্ন ভূখণ্ড ছিল, কিন্তু এক্ষণে মধ্যস্থল দিয়া পদ্মা প্রবাহিত হওয়ায়, উত্তর বিক্রমপুর হইতে দক্ষিণ বিক্রমপুর পৃথক্ হইয়া পড়িয়াছে। যাহা হউক, সমতটের দক্ষিণস্থ ভূভাগ যে সমুদ্রতটে অবস্থিত ছিল, তাহা বলাই বাহুল্য। সমতট এবং ব্রহ্মপুত্রের পূর্ব্বস্থিত ভূভাগ সকল, অর্থাৎ আধুনিক ত্রিপুরা, নোয়াখালি এবং চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে তৎকালে কিরাতাদি বিবিধ অনার্য্যজাতির নিবাস ছিল।
পূর্ব্বোক্ত কাজিনগড়ের দক্ষিণ হইতে এবং ভাগীরথীর পশ্চিম তট বাহিয়া প্রাচীন বঙ্গরাজ্য। উহা দক্ষিণে মেদিনীপুরেরভাগীরথীর পশ্চিম কূলস্থ প্রাচীন বঙ্গের দক্ষিণ হইতে সম্ভবতঃ সমস্ত মেদিনীপুর জেলা এবং বালেশ্বর জেলারও কিয়দংশ লইয়। তদানীন্তন তাম্রলিপ্তি রাজ্য। বর্তমান তমলুক নগর উহার রাজধানী এবং বাণিজ্য বন্দর ছিল। মহাভারতের বনপর্ব্বে ১১৪ অধ্যায়ে উল্লিখিত হইয়াছে যে, রাজা যুধিষ্ঠির পঞ্চশত নদীসমন্বিত গঙ্গাসাগরে তীর্থস্নানাদি করিয়া, সমুদ্রের ধার দিয়া কলিঙ্গ দেশে উপনীত হন। ঐ কলিঙ্গের মধ্যে বৈতরণী নদী প্রবাহিত। [তাম্রলিপ্তি দেখ।]
উপরে বাঙ্গালার গঠন ও দেশাদির অবস্থান সম্বন্ধে যাহা লিখিত হইল, তাহার আনুপূর্ব্বিক ইতিবৃত্ত বাঙ্গালার পুরাতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে সবিস্তার আলোচিত হইয়াছে।
ভূতত্ত্ববিদ্ ব্লান্ফোর্ড, বাঙ্গালা প্রান্তরের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা করিয়া লিথিয়াছেন যে, প্রথমে বালুকা-কর্দ্দমমিশ্রিত জীবদেহ ও উদ্ভিজ্জাদিজাত পলিজ স্তরবিশেষ (Loam) রূপান্তরিত হইয়া ভূপৃষ্ঠোপরি ন্যস্ত হয়। ক্রমে তদুপরি নদীজলবিধৌত বালুকাকণা সঞ্চিত হইয়া উহা উচ্চ ভূমির আকারে পরিণত হইয়া থাকে। কলিকাতা ও তৎসন্নিহিত প্রদেশ, ২৪ পরগণা ও যশোরজেলার নানাস্থানের পুষ্করিণী খননকালে ভূপঞ্জরস্থ মৃত্তিকাস্তর পর্য্যবেক্ষণ করিয়া তিনি তথাকার স্তরগুলির গঠন পর্য্যায় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। কলিকাতার শিবাদহের নিকটে একটী পুষ্করিণী খননকালে তিনি ভূপৃষ্ঠের পর যথাক্রমে ‘ফাইন্ সাণ্ড’ লোম, ব্লু ক্লে ও পিট্ লেয়ার (Peat layer) বা অপরিণত পাথুরে কয়লার সামান্য স্তর দেখিতে পান। নিম্নবঙ্গের স্থানবিশেষে এই পিট্ লেয়ার বা কৃষ্ণবর্ণ কয়লাস্তর ২০´ হইতে ৩০´ ফিট্ পর্য্যন্ত নিম্নে সন্নিবিষ্ট আছে। এই কৃষ্ণস্তরের অব্যবহিত পরে প্রায় ১১ ফিট্ পর্য্যন্ত বালুকামিশ্রিত কর্দ্দমস্তর (Sand clay), তাহার পর ১৫ ফিট্ পর্য্যন্ত পুনরায় ব্লু ক্লে নামক স্তর। শেষোক্ত দুইটী স্তরে তিনি অসংখ্য উন্নতশিরঃ সুন্দরী গাছের গুঁড়ি,