নরপতিগণের বীরত্বগৌরব শিলালিপিতে ও প্রাচীন কুলগ্রন্থে বিবৃত আছে। বাঙ্গালা মুসলমানের পদাবনত হইবার পরও বারভূঁয়ার অতুল প্রতাপ সমগ্র বঙ্গে প্রতিধ্বনিত হইয়াছিল। রাজা প্রতাপাদিত্য, কংসনারায়ণ, সীতারাম প্রভৃতির বীরত্বকাহিনী ও যুদ্ধনিপুণতার বিষয় কে না অবগত আছেন? বেশী দিনের কথা নহে, খৃষ্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দের মধ্যভাগে জানকীরাম, মোহনলাল প্রভৃতি বাঙ্গালী বীরকে আমরা বাঙ্গালার রণক্ষেত্রে সদলবলে অবতীর্ণ দেখিতে পাই। তৎপরে ঊনবিংশ শতাব্দে লেফ্টেনাণ্ট কালুঘোষও সে বীরত্ব প্রভাবের অক্ষুণ্ণ রশ্মি বহন করিয়াছিলেন—আজিও শ্রীমান্ সুরেশচন্দ্র বিশ্বাস ব্রেজিল রাজ্যে বাঙ্গালীর বীরত্ব ভাতি উদ্ভাসিত করিতেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইংরাজরাজের কঠোর শাসনে ও রাজদণ্ডবিধির নিয়মবশে সকল গৌরব ও খ্যাতি কোথায় বিলুপ্ত হইয়াছে, তাহার নিদর্শনমাত্রও যেন নাই।
সুপ্রসিদ্ধ ও প্রাচীন বাঙ্গালার বিভিন্ন রাজবংশগুলি আর সেরূপ রাজশক্তিসম্পন্ন নহেন। দরিদ্রতাদোষে তাঁহারাও সকলে এখন নিস্তেজ ও নিম্প্রভ। তাঁহাদের বংশধরগণ এক্ষণে উপাধিভারমাত্র বহন করিয়াই সন্তুষ্ট। কোন কোন রাজবংশ ঋণজালে জড়িত হওয়ায় গবর্মেণ্টের অধীন থাকিয়া বৃত্তিমাত্রের উপভোগী হইতে বাধ্য হইয়াছেন। বৰ্দ্ধমানরাজ, বিষ্ণুপুররাজ, ছোটনাগপুর ও চঙ্গ-ভাকরের রাজদ্বয়, দরভাঙ্গাপতি, খুর্দ্দারাজ, যশোররাজ, কোচবিহার-রাজ, নদীয়ারাজ, নাটোররাজ, রামগড়ের রাজা এবং সরগুজা ও উদয়পুরের নরপতিবংশ এক্ষণে বল, বীর্য্য ও সামর্থ্যহীন হইয়া পড়িয়াছেন। এতদ্ভিন্ন আরও অনেক জমিদার ও রাজা আছেন, তাঁহারা রাজানুগ্রহ লাভ ভিন্ন, কখনও স্বাধীনতা লাভেচ্ছা প্রকাশ করেন নাই। বরং রাজানুগ্রহলাভেচ্ছায় এবং স্বীয় বিষয়বাসনা পরিতৃপ্তিকামনায় নিরন্তর অবিবেচকের ন্যায় দরিদ্র প্রজাবৃন্দের রক্তশোষণ কবিতেছেন। অর্থক্ষয়নিবন্ধন প্রজার বাহুবল অপনোদিত হইয়াছে এবং সেই সঙ্গে সঙ্গে রাজশক্তিরও অভাব ঘটিতেছে। ধনহারা প্রজাগণ এইরূপে অন্ন বিনা মারা যাইতেছে। তাহার উপর ভগবান্ কষ্টের উপর কষ্ট দিতেছেন, দীনদুঃখীর দুরদৃষ্টক্রমে দুর্ভিক্ষের পর দুর্ভিক্ষ আসিয়া দেখা দিতেছে, অনাবৃষ্টি হেতু জলাভাবে অন্নাভাব ঘটিয়া প্রজার সর্ব্বনাশ সাধিত হইতেছে।
ধর্ম্ম।
বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্ম্মস্রোতের প্রবল বন্যা এক সময়ে বাঙ্গালায় অপ্রতিহত গতিতে প্রবাহিত ছিল। পালবংশীয় বৌদ্ধ রাজগণের অধিকারে বৌদ্ধধর্ম্মের যে অক্ষুণ্ণ প্রভাব বাঙ্গালায় বিরাজ করিয়াছিল, আজিও তান্ত্রিক উপাসনায় তাহার প্রভূত নিদর্শন রহিয়াছে। বৈদিক উপাসনাপদ্ধতি তৎকালে একবারেই বঙ্গরাজ্য হইতে অন্তর্হিত হয়। তাই মহারাজ আদিশূর কনোজ হইতে পঞ্চ সাগ্নিক ব্রাহ্মণ আনাইয়া বাঙ্গালায় বেদমার্গ প্রশস্ত রাখিতে চেষ্টিত হন। তাঁহার পরবর্ত্তী সেনবংশীয় হিন্দুরাজগণও হিন্দুধর্ম্মপ্রতিষ্ঠাকল্পে বিশেষ মনোযোগী হইয়াছিলেন। বল্লালের কৌলীন্য-মর্য্যাদা এই ব্রহ্মণ্য-প্রভাব বিস্তারের অবান্তর ফল।
বৌদ্ধ ও হিন্দুর সমসময়ে বাঙ্গালায় জৈনধর্ম্মের বিস্তার ঘটিয়াছিল। এখনও নানা স্থানে জৈন ও বৌদ্ধকীর্ত্তি পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। ঐ সকল কীর্ত্তির বিবরণ বাঙ্গালার প্রত্নতত্ত্ব প্রসঙ্গে বিবৃত হইয়াছে। [হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধধর্ম্মের বিশেষ বিবরণ তত্তৎ শব্দে দ্রষ্টব্য।]
অতঃপর সেনবংশের অধঃপতনে বাঙ্গালায় মুসলমানের অভ্যুদয় ঘটিলে এখানে পাঠান, মোগল প্রভৃতি বিভিন্ন শ্রেণীর ইস্লাম-ধর্ম্মাবলম্বীর অভ্যুদয় হয়। সেই সঙ্গে বঙ্গবাসিগণও ইস্লাম-ধর্ম্মে দীক্ষাগ্রহণ করে। সেই সময় হইতে বাঙ্গালায় অনেক মুসলমান সাধু, ফকির পীর প্রভৃতির আবির্ভাব হইয়াছে। ঐ সকল পীরস্থানে আজিও মেলা হয় এবং হিন্দু মুসলমান উভয় শ্রেণীর লোক তথায় যাইয়া ভক্তিপূর্ব্বক পূজা দিয়া থাকে। বহুকাল মুসলমান সহবাসের ফলে, হিন্দুসমাজে সত্যনারায়ণের (সত্যপীর) পূজা প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। [মুসলমান শব্দ দেখ।]
বাঙ্গালায় মুসলমানরাজত্বের মধ্যকালে অর্থাৎ খৃষ্টীয় ১৫শ শতাব্দের শেষ সময়ে ১৪৮৫ খৃষ্টাব্দে নবদ্বীপধামে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব ঘটে। বঙ্গের সুবিখ্যাত সুলতান হুসেনশাহ ও নসরৎ শাহের রাজত্বকালে তিনি স্বীয় বৈষ্ণবমত প্রচার করেন। তাঁহার তিরোধানের পর, বৈষ্ণবধর্ম্ম উত্তরোত্তর প্রতিষ্ঠালাভ করিতে থাকে। তাঁহার সমসাময়িক ও পরবর্ত্তী বৈষ্ণব কবিগণ