গর্ভে ঋষি দীর্ঘতমা পাঁচ পুত্রের জন্ম দেন। এই পঞ্চ পুত্রের নাম অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুহ্ম। তাঁহাদের নামানুসারে এক একটী দেশ বিখ্যাত।[১]
হরিবংশেও লিখিত আছে, পরমযোগী রাজা বলি ঊৰ্দ্ধরেতা ছিলেন। এজন্য তাঁহার পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে মহাতেজস্বী মুনিবর দীর্ঘতমা হইতে পঞ্চ ক্ষেত্রজ তনয় উৎপন্ন হয়। যোগাত্মা বলি সেই নিষ্পাপ পঞ্চ পুত্রকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিয়া যোগমার্গ আশ্রয় করেন। (৩১ অধ্যায়)
উদ্ধৃত প্রমাণবলে বলিতে হয় যে, বলি অথবা তাঁহার পঞ্চ পুত্র হইতেই অঙ্গবঙ্গাদি জনপদে বৈদিক সভ্যতা প্রচারিত ও চাতুর্বর্ণ্য সমাজ গঠিত হয়।[২]
মহাভারতকার বলিপুত্র অঙ্গ, বঙ্গাদির নামানুসারে ভিন্ন ভিন্ন দেশের নামোৎপত্তি স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু পূর্ব্বোক্ত অথর্ব্ববেদ, ঐতরেয় ব্রাহ্মণ ও ঐতরেয় আরণ্যকের অনুবর্ত্তী হইলে অবশ্যই বলিতে হয় যে আর্য্যসভ্যতা বিস্তারের পূর্ব্বে অঙ্গ, বঙ্গ, ও পুণ্ড্রের নাম করণ হইয়াছিল। বলিপুত্রগণ যিনি যে রাজ্যে অধিকার পাইয়াছিলেন, তিনি সেই রাজ্যের নামানুসারেই সম্ভবতঃ বিখ্যাত হইয়াছিলেন। যেমন পৌণ্ড্রের অধিপতি মহাবল বাসুদেব নানা পুরাণে কেবল মাত্র ‘পৌণ্ড্রক’ নামেই পরিচিত আছেন।
বলিপুত্র অঙ্গের ষষ্ঠ পুরুষ অধস্তন অঙ্গাধিপ দশরথ লোমপাদ নামে বিখ্যাত ছিলেন। ইনি শ্রীরামচন্দ্রের পিতা দশরথের সখা ও ঋষ্যশৃঙ্গের শ্বশুর। লোমপাদের প্রপ্রৌত্ত্র চম্প হইতে অঙ্গ বাজ্যের রাজধানী চম্পা নামে প্রসিদ্ধ হয়। অঙ্গাধিপ চম্পের প্রপৌত্ত্র-পৌত্র বৃহন্নলার বিজয় নামে এক পুত্র জন্মে। হরিবংশে তিনি ‘ব্রহ্মক্ষত্রোত্তর’[৩] বিশেষণে প্রসিদ্ধ হইয়াছেন। এই বিজয়ের প্রপৌত্রপুত্র অধিরথ সূতবৃত্তি অবলম্বন করায় ক্ষত্রিয়সমাজে নিন্দিত হইয়াছিলেন। সূত অধিরথ কর্ণকে প্রতিগ্রহ করিয়াছিলেন বলিয়া কর্ণকে সকলে সূতপুত্র বলিত।[৪] ——
- ↑ “অঙ্গো বঙ্গঃ কলিঙ্গশ্চ পুণ্ড্রসুহ্মশ্চ তে সূতাঃ।
তেষাং দেশাঃ সমাখ্যাতাঃ স্বনামকথিতা ভুবি।”(মহাভারত আদি৹ ১০৪৷৫০) - ↑ “বলে চাপ্রতিমত্বং বৈ ধর্ম্মতত্ত্বার্থদর্শনম্।
চতুরো নিয়তান্ বর্ণাংস্ত্বঞ্চ স্থাপয়িতেভি হ।” (হরিবংশ ৩১।৩৮) - ↑ “ব্রহ্মক্ষত্রোত্তরঃ সত্যাং বিজয়োনাম বিশ্রুতঃ।” (হরিবংশ ৩১।৫৭)।
এখানে ‘ব্রহ্মক্ষত্রোত্তর’ শব্দের কেহ অর্থ করিয়াছেন, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় উভয় ধর্ম্মাবলম্বী, আবার অনেকে অর্থ করিয়াছেন,—“শান্তি প্রভৃতি দ্বারা ব্রাহ্মণ হইতে উৎকৃষ্ট এবং বীর্য্যাদি দ্বারা ক্ষত্রিয় হইতে শ্রেষ্ঠ।” - ↑ হরিবংশ ৩১ অধ্যায়ে পূর্ব্বাপর বংশাবলি ও অপর বিবরণ দ্রষ্টব্য।
যাহা হউক, হরিবংশের বিবরণে যদি কিছুমাত্র ঐতিহাসিকতা থাকে, তাহা হইলে অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে যে, পৌরব ক্ষত্রিয়রাজ বলির সময় অর্থাৎ মহাবীর কর্ণের সপ্তদশ পুরুষ পূর্ব্ব হইতেই (বর্ত্তমান সময়ের পাঁচহাজার বর্ষেরও পূর্ব্বকালে) অঙ্গবঙ্গে ক্ষত্রিয় সমাজের প্রতিষ্ঠা ঘটয়াছিল। এমন কি, এখানকার অনেক নৃপতি যোগবলে বা কর্ম্মফলে ব্রাহ্মণত্ব পর্য্যন্ত লাভ করিয়াছিলেন। সেই সুপ্রাচীন কাল হইতেই বাঙ্গালীর জন্মভূমি বহু সাত্ত্বিক যোগী, ঋষি, জ্ঞানী, মানী ও মহাবীরের লীলাস্থলী হইয়াছিল। এই কারণে বৌধায়ন ধর্ম্মসূত্রে ও মনুসংহিতায় যে স্থান আর্য্যাবাসের অনুপযুক্ত বলিয়া ঘোষিত হইয়াছিল, মহাভারতে বঙ্গপ্রান্ত সেই কলিঙ্গদেশ ‘যজ্ঞিয় গিরিশোভিত সতত দ্বিজসেবিত’ পুণ্যস্থান বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়াছে।[১]
মহাভারত হইতে আমরা আরও জানিতে পারি যে, মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞকালে এই বঙ্গদেশ নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। ভীমের পূর্ব্ব দিগ্বিজয় উপলক্ষে সভাপর্ব্বে লিখিত আছে,—
“ভীমসেন স্বপক্ষ হইলেও সুহ্ম প্রসুহ্মদিগকে যুদ্ধে জয় করিয়া মগধদিগের উদ্দেশে গমন করিলেন। তথায় দণ্ড, দণ্ডধার ও অপরাপর মহীপালদিগকে পরাজয় করিয়া তাহাদের সকলের সমবেত হইয়াই গিরিব্রজে উপনীত হইলেন এবং জরাসন্ধনন্দন সহদেবকে সান্ত্বনাযুক্ত ও করায়ত্ত করিয়া সকলকে সঙ্গে লইয়া কর্ণের প্রতি ধাবমান হইলেন। অনন্তর পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ ভীম চতুরঙ্গ বলে পৃথিবী কম্পিত করিয়া শত্রুনাশন কর্ণের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিলেন এবং তাহাকে সংগ্রামে পরাজিত ও বশীভূত করিয়া পর্ব্বতবাসী রাজগণকে জয় করিলেন। অতঃপর পাণ্ডববীর মোদাগিরিস্থ অতিবলশালী রাজাকে মহাসমরে বাহুবলে নিহত করিলেন। তৎপরে তীব্র পরাক্রম ও মহাবাহু পুণ্ড্রাধিপ বাসুদেব ও কৌশিকীকচ্ছনিবাসী রাজা মহৌজা এই দুই নৃপতিকে যুদ্ধে নির্জ্জিত করিয়া বঙ্গরাজের প্রতি ধাবিত হইলেন। সমুদ্রসেন ও চন্দ্রসেন নরপতিকে পরাজয় করিয়া তাম্রলিপ্তরাজ, কর্ব্বটাধিপতি, সুহ্মাধিপতি, ও সাগরবাসী সকল স্লেচ্ছগণকে জয় করিয়াছিলেন![২]
——